আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার পার্থক্য

আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার পার্থক্য
Written by IQRA Bari

ইসলামিক শিক্ষা নীতিতে বর্তমানে দুটি আলাদা আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যথা -কওমি মাদ্রাসা ও আলিয়া মাদ্রাসা। আমরা সাধারণত ইলমে ওহী ভিত্তিক জ্ঞানার্জনের জন্য এই দুটি শিক্ষা ব্যবস্থারই শরণাপন্ন হই। কিন্তু একই শিক্ষানীতির উপর দুটি আলাদা আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা কেন? আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার পার্থক্য কি?

আমাদের দ্বীনি ভাই-বোনদের মাঝে কওমি মাদ্রাসা ও আলিয়া মাদ্রাসা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এবং বিতর্কের সৃষ্টি হতে দেখেছি। তাই আজ আমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে আপনাদের সামনে “কওমি মাদ্রাসা ও আলিয়া মাদ্রাসার পার্থক্য” উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো।

আলিয়া মাদ্রাসা কি ও কেন?

কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে যদি ‘মাদ্রাসা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তবে আমরা সকলেই এটিকে ইসলামি শিক্ষার একটি প্রাণকেন্দ্র হিসেবেই বিবেচনা করি। আর এটাই অকাট্য সত্য।

আলিয়া মাদ্রাসা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থারই একটি ধারা। অর্থাৎ, আলিয়া মাদ্রাসাতেও কুরআন, হাদিস এবং ফিকহি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলা, ইংরেজি, গনিত, ইতিহাস ও দর্শন ইত্যাদি বিষয়ও পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভূক্ত।

আরও পড়ুনঃ কওমি মাদ্রাসার ক্লাসের নাম সমূহ

সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে, জেনারেল শিক্ষার একটি বিকল্প হলো আলিয়া মাদ্রাসা। অর্থাৎ, সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার পুরো সিলেবাসই আলিয়া মাদ্রাসাতে কম-বেশি পড়ানো হয়। তবে এটি একটি ’মাদ্রাসা’ বা ইসলামি শিক্ষা প্রসারের স্লোগান নিয়ে সামনে চলার দরুণ ইসলামি পাঠ্যবই গুলোকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়।

আলিমা মাদ্রাসার নিজস্ব শিক্ষা বোর্ড রয়েছে এবং এটি সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাস সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। উক্ত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরকে বোর্ড পরীক্ষার মাধ্যমে “বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড” কর্তৃক সরকারি তত্ত্বাবধানে সনদ প্রদান করা হয়।

আলিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রাপ্ত সনদ সরকারি হওয়ায় এর মাধ্যমে সরকারি চাকরিও নেওয়া যায়। এটাই হলো আলিয়া মাদ্রাসার সাধারণ পরিচিতি।

কওমি মাদ্রাসা কি ও কেন?

কওমি মাদ্রাসাও ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার একটি প্রাণকেন্দ্র। কওমি মাদ্রাসাতে কুরআন, হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর পাঠদান করা হয়।

কওমি মাদ্রাসাতেও পড়ানো হয় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও গণিত ইত্যাদি। তবে তুলনামূলক ভাবে ইংরেজি ও গণিত কওমি মাদ্রাসায় কম পড়ানো হয়।

কওমি মাদ্রাসা সরকারি অর্থায়নভুক্ত নয়। শিক্ষার্থীদের বেতন ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতার উপর নির্ভর করে চলে।

আরও পড়ুনঃ আলিম ক্লাসের বইয়ের তালিকা 

কওমি মাদ্রাসার নিজস্ব শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। বোর্ড কর্তৃক পরীক্ষার মাধ্যমে কওমি শিক্ষার্থীদেরকে সনদ প্রদান করা হয়। তবে এটি কোনো সরকারি সনদ নয়।

যদিও কিছুদিন আগে কওমি মাদ্রাসার দারুল হাদিস পরীক্ষার্কে মাস্টার্সের সমমান দেওয়া হয়েছে, তবে এর কার্যকারীতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। যাইহোক,

সাধারণ ভাবে কওমি মাদ্রাসা – আলিয়া মাদ্রাসার একটি বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বলা যেতে পারে। তবে এরমধ্যে আরও বিভিন্ন বিষয় রয়েছে, যা নিচে উল্লেখ করা হলো।

আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার পার্থক্য

’আলিয়া ও কওমি’ এই দুটিই ইসলামি শিক্ষার প্রসারেই যুগ যুগ ধরেই কাজ করছে। মাদ্রাসা হিসেবে এই দুটো আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থাতেই কুরআন -হাদিসের পাঠদান করা হয়।

আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার পার্থক্য করতে গেলে বেশকিছু বিষয় সামনে চলে আসে। তারমধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থ্যকের কারণ হলো আমলিয়াত ও পর্দা।

আমলিয়াত

আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাস মূলত সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসকেই অনুসরণ করে। তাই আলিয়া মাদ্রাসায় ইসলামি জ্ঞানের চর্চা থাকার পরও আমলিয়াতের দিক দিয়ে তারা কওমি থেকে কিছুটা পিছিয়ে!

আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সাধারণত অনাবাসিক বা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে। তারা মাদ্রাসায় থাকাকালীন সময়ে কর্তৃপক্ষের চাপে নামাজ আদায় করলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই মাদ্রাসার বাহিরে অবস্থানকালে নামাজ পড়ে না। পোশাক এবং দাড়ির ব্যাপারেও তাদের মাঝে অলস্য মনোভাব লক্ষ্য করা যায়।

আরও পড়ুনঃ ক্রিয়াপদ কাকে বলে এবং কত প্রকার ও কি কি?

অন্যদিকে কওমি শিক্ষার্থীরা আবাসিক বা মাদ্রাসায় থেকে পড়াশোনার কারণে ২৪ ঘন্টাই শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে থাকে। ফলে নামাজ, সুন্নতি পোশাক, দাড়ি ও বিভিন্ন ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত আমলের প্রতি শিক্ষার্থীদেরকে বিশেষ জোর দেওয়া হয়।

কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার থাকাকালীন সময়ে যে কোনো ডিজিটাল ডিভাইস তাদের জন্য নিষিদ্ধ। তাই মোবাইলের ফেতনা থেকে তারা মুক্ত।

পর্দা

ইসলামি শরীয়তে পর্দার হুকুম ফরজ করা হয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসায় সহশিক্ষা অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে একই ‍রুমে একসাথে বসে পড়াশোনার কারণে পর্দার মতো ফরজ বিধানটি সঠিক ভাবে পালন করা হয় না।

অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসায় ছেলেরা আলাদা এবং মেয়েরা আলাদা ভাবে পড়াশোনা করে। কওমি মাদ্রাসার মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে সম্পূর্ণ শরীয়ত মোতাবেক পর্দা করা বাধ্যতামূলক।

কিন্তু আলিয়া মাদ্রাসার মেয়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণ ভাবে বোরকার মাধ্যমে পর্দা করলেও শরীয়ত সম্মত পর্দা বেশিরভাগ মেয়ে শিক্ষার্থীরাই করে না। করতেও চায় না।

কওমি মাদ্রাসার ছেলে শিক্ষার্থীরা কখনই মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যেতে পারে না, আবার মেয়ে শিক্ষার্থীরাও ছেলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যেতে পারে না।

এমনকি কুরআনে নির্দেশিত আপনদের চৌদ্দ জন পুরুষ ছাড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আত্মীয়দেরও কেউ কথা বলতে বা দেখা করতে পারে না।

মোটকথা, পর্দার বিষয়টা সামনে আসলে আলিয়া মাদ্রাসা কওমি মাদ্রাসার ধারে-কাছেও নেই। এটাই বাস্তবতা।

আরও পড়ুনঃ বাংলা ভাষার মূল উপাদান কি?

আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার আরো একটি পার্থক্য হলো শিক্ষক নির্বাচন। লক্ষ্য করলে দেখা যায় আলিয়া মাদ্রাসায় অনেক মুশরিক অর্থাৎ আল্লাহর একাত্ববাদে অবিশ্বাসী শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়। যা অনেকটা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মতই।

আল্লাহর একাত্ববাদকে অবিশ্বাসী শিক্ষক যদি মাদ্রাসায় পাঠদান করে তবে এটা অকাট্য সত্য যে, তার মাধ্যমে অনেক বিধর্মীয় কালচার মুসলিম শিক্ষার্থীদের মাঝে অজান্তেই প্রবেশ করবে। ফলে আকিদাগত ভাবে শিক্ষার্থীরা দ্বীধায় পড়ে যেতে পারে। অনেক ইসলামি স্কলারগণ এই বিষয়ে ইতোমধ্যেই মন্তব্য করেছেন।

কওমি মাদ্রাসায় এমন কোনো সুযোগই নেই। শিক্ষক নির্বাচনে কওমি মাদ্রাসা গুলোতে যোগ্যতার পাশাপাশি আমলিয়াতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ, শিক্ষকগণই হবে কোমলমতি মুসলিম শিক্ষার্থীদের অভিভাবক।

প্রয়োজনীয় ও পরিবর্তনীয়

ইসলামি শিক্ষা অঙ্গনে কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার অনেক অবদান আছে। যা কোনো ভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে ‘মাদ্রাসা’ নামে যেহেতু এই প্রতিষ্ঠান গুলো পরিচালিত হয়, সেহেতু ইসলামি শরীয়তের কোনো বিষয়কে ছোট করে দেখা অপ্রত্যাশিত।

মুমিন জীবনে আমলিয়াত ও পর্দার মতো একটি ফরজ বিধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুমিনের আসল সম্বলই তো এগুলো।

আরও পড়ুনঃ প্রত্যয় কাকে বলে এবং কত প্রকার ও কি কি?

আলিয়া মাদ্রাসার সহশিক্ষাতে পরিবর্তন আনা জরুরি। অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদেরকে আলাদা আলাদা ক্লাস রুমে বা ছেলে-মেয়েদের মাঝখানে একটি পার্টিশনের ব্যবস্থা রাখা উচিত। এতে করে ইসলামি শরীয়তের পর্দার বিধানটাও মান্য হবে।

শেষ কথাঃ

প্রিয় পাঠক, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার পার্থক্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। এই ব্লগটি বিভিন্ন মানুষের মতামতের ভিত্তিতে মধ্যমপন্থা অনুসরণ করেই লেখা হয়েছে। আমরা কখনই কোনো মাদ্রাসারই বিপক্ষে নই। এই দুটি মাদ্রাসাই আমাদের মুসলিম জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে সাধারণ ভাবে ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে কওমি মাদ্রাসা গুলোতে ইলমে ওহীর জ্ঞানকে যেভাবে ধারণ করা হয় এবং যেভাবে তার উপর আমল করা হয়, তা আলিয়া মাদ্রাসাতে তুলনামূলক কম। এজন্য সকল আলিয়া মাদ্রাসাতেই উপযুক্ত উলামায়ে-কেরামকেই দায়ীত্বশীল বানানো উচিত। তবেই কেবল নিয়ম নীতিতে পরিবর্তন সম্ভব।

মহান আল্লাহ তা’আলা মুসলিম জাতির গর্ব ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার এই দুটি প্রধান মাদ্রাসা আলিয়া ও কওমিকে কবুল করুন। পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আমাকে এবং আমাদের সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দিন। আমিন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!