মুসলমানদের জাতীয় শিক্ষা নামে খ্যাত কওমি মাদ্রাসা হলো একটি ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা, যা ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মধ্যদিয়ে শুরু হয়। আধুনিক ও গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কেন এটিকে আলাদা মনে হয়, তা কওমি মাদ্রাসার বৈশিষ্ট্য সমূহের দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায়।
’কওম’ থেকে ‘কওমি’ শব্দের উৎপত্তি। কওম অর্থ হলো জাতি, এবং কওমি অর্থ জাতীয়। আর মাদ্রাসা অর্থ হলো বিদ্যালয়। তারমানে ‘কওমি মাদ্রাসা’ অর্থ হলো ‘জাতীয় বিদ্যালয় ‘।
মাদ্রাসা শিক্ষার উৎস মূলত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর মাধ্যমেই শুরু হয়। তিনি হেরা পর্বতের মাঝে প্রভুর সান্নিধ্যে ধ্যানমগ্ন ছিলেন এবং মহান প্রভুর পক্ষথেকে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে ওহী প্রাপ্ত হন, যেখানে সূরা আলাকের প্রথম আয়াত তথা ‘ইকরা’ শব্দের মাধ্যমে শিক্ষার সূচনা হয়।
কওমি মাদ্রাসা মূলত সেই শিক্ষার অনুকরণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কওমি মাদ্রসায় কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসির, উসুলুল হাদিস, আরবি সাহিত্য, ইসলামি ইতিহাস ও দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়।
কওমি মাদ্রাসাগুলো সাধারণত সরকারি অনুদানের পরিবর্তে সাধারণ মুসলিম জাতির সাহায্য ও সহযোগিতায় পরিচালিত হয়।
কওমি মাদ্রাসার বৈশিষ্ট্য সমূহ
কওমি মাদ্রাসার বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের কথা বলা আছে। তবে বিশেষ যে বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে কওমি মাদ্রাসা সুনাম ধরে রেখেছে তা হলো:
১. ধর্মীয় শিক্ষার উপর জোর: কওমি মাদ্রাসার প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করা। এজন্য কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসির, উসুলুল হাদিস, আরবি সাহিত্য, ইসলামি ইতিহাস ও দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন করা হয়।
২. ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা পদ্ধতি: কওমি মাদ্রাসাগুলোতে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন।
৩. স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম: কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিজস্ব শিক্ষাক্রম রয়েছে। এই শিক্ষাক্রমে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার কিছু বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৪. স্বতন্ত্র পরীক্ষা ব্যবস্থা: কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিজস্ব পরীক্ষা ব্যবস্থাও রয়েছে। শিক্ষার্থীরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করতে পারে।
৫. খোদাভীতি বা তাকওয়া: কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মহান আল্লাহর একাত্ববাদে যেমন বিশ্বাসী, ঠিক তেমনী ভাবে তারা নিজেরা এবং তাদের পরিবারকে ইসলামি জীবনব্যস্থার দিকে পরিচালিত করে থাকেন।
৬. ত্যাগী ও পরোপকারী: কওমি মাদ্রাসায় রাসূল স. এর আদর্শের উপর সর্বোচ্চ অনুসরণের তাকিদ রয়েছে, ফলে শিক্ষার্থীরা ত্যাগী ও পরোপকারী হয়।
৭. সমাজসেবা ও মানবতা: কওমি মাদ্রাসা থেকে ন্যায়পরায়ন সমাজসেবক এবং মানবতাবাদী মানুষ তৈরি হয়। যারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে আখেরাতকে বেশি প্রাধান্য দেয়।
এগুলো ছাড়াও, কওমি মাদ্রাসার বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম শিক্ষা হলো –
- আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে হবে।
- অল্পে তুষ্ট থাকতে হবে।
- চরিত্র সুন্দর করতে হবে।
- চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, দখল, সন্ত্রাস, মাদক, নির্যাতন, দুর্নীতি ও প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
- অশ্লীলতা, নগ্নতা, ধর্ষণ ও সকল অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে।
কওমি মাদ্রাসাগুলো এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য গুলো নিয়ে সারা পৃথিবীতেই সুনাম ছড়িয়ে আছে। এজন্যই দেখা যায় যে, কোন সামাজিক অপকর্মের সাথে কওমি মাদ্রাসা পড়ুয়ারা জড়িত থাকে না।
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাগুলোর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার উদ্ভব হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে কয়েক হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসা থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসছে।
কওমি মাদ্রাসাগুলো বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষার অন্যতম প্রধান উৎস। এসব মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য খাঁটি ও আদর্শ মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবেই কওমি মাদ্রাসাকে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।