সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম কানুন (A-Z বিস্তারিত)

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম কানুন
Written by IQRA Bari

নামাজের মাধ্যমেই মুমিন বান্দারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে নেয়। সালাতুত তাসবিহ ( صلاة تسبيح ) নামে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি নামাজ রয়েছে। আজ আমি আপনাদেরকে সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম কানুন বিস্তারিত ভাবে বলব।

সালাতুত তাসবিহ নামাজ প্রত্যেকের জীবনে অন্তত একবার হলেও পড়া উচিত! এই নামাজটি পড়লে বিগত জীবনের সমস্ত গোনাহ মহান আল্লাহ ক্ষমা করে দেন এবং এই নামাজের মাধ্যমে অনেক নেকি হাসিল করা যায়।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ত, ফজিলত, দোয়া বা তাসবিহ এবং পড়ার পদ্ধতি সহ যাবতীয় বিষয়াবলী ধারাবাহিক ভাবে নিচে তুলে ধরা হলো। চলুন জেনে নেওয়া যাক সালাতুত তাসবিহ এর নিয়ম কানুন।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের ফজিলত কি?

সালাতুত তাসবিহ সম্পর্কে হাদিসে বিভিন্ন ফজিলতের কথা বর্ণিত আছে। তারমধ্যে একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আব্বাস রাযি. -কে শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, হে চাচা! সালাতুত তাসবিহ নামাজ পড়ার দ্বারা সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।

আরও পড়ুনঃ নামাজের ফরজ কয়টি ও কি কি?

আপনি যদি সালাতুত তাসবিহ নামাজের আমল করেন তবে –

  • আল্লাহ আপনার আগের, পরের, নতুন, পুরাতন, সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
  • ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
  • সগিরা ও কবিরা গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
  • গোপনে বা প্রকাশ্যের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।

হে চাচা! আপনার পক্ষে যদি সম্ভব হয়, তাহলে প্রতিদিন একবার এই নামাজ পড়বেন। আর নাহয় সাপ্তাহে একবার, অন্যথায় মাসে একবার আর যদি এটাও সম্ভব নাহয় তাহলে বছরে একবার হলেও পড়বেন। -তিরমিজি

সালাতুত তাসবিহ নামাজ কত রাকাত?

সালাতুত তাসবীহের নামাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে চার রাকাতের বর্ণনা পাওয়া যায়। উত্তম হলো, চার রাকাত এক সালামে পড়া। যদি দুই সালামে পড়া হয় তবুও আদায় হয়ে যাবে।

প্রত্যেক রাকাতে ৭৫ বার দোয়া বা তাসবীহ পাঠ করতে হয়। অর্থাৎ, ৪ রাকাত নামাজে মোট ৩০০ বার তাসবীহ পাঠ করতে হবে।

সালাতুত তাসবিহ নামাজ সুন্নত না নফল?

সালাতুত তাসবিহ নামাজ একটি ঐচ্ছিক ইবাদত। এটা বাধ্যতামূলক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মতো নয়। সালাতুত তাসবিহ নামাজকে ‘মুস্তাহাব’ বলা হয়।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের সময়

সালাতুত তাসবিহ নামাজ যেহেতু মুস্তাহাব নামাজের অন্তর্ভূক্ত, সেহেতু নামাজের নিষিদ্ধ সময় বাদে দিন- রাতের যে কোনো সময় পড়া জায়েজ। তবে উত্তম হলো নিরিবিলি জায়গায় এই নামাজটি পড়া। তাহলে নামাজে মনোযোগ আসবে।

নিরিবিলি বলতে অনেক আলেমগণ সালাতুত তাসবিহ নামাজ রাতের বেলা পড়াকে উত্তম মনে করেন। আবার অনেকেই রাতের শেষাংশ অর্থাৎ, তাহাজ্জুদ নামাজের সময় পড়াকে উত্তম মনে করেন।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের দোয়া বা তাসবিহ

সালাতুত তাসবিহ ৪ রাকাত নামাজে এই তাসবিহটা ৩০০ বার পড়তে হয় –

আরবিঃ سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ

বাংলা উচ্চারণঃ সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।

অর্থঃ আল্লাহ মহান, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আল্লাহ্ মহান।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

যে কোনো কাজের পূর্বেই একটি নিয়ত বা উদ্দেশ্য থাকা চাই। সালাতুত তাসবিহ নামাজ পড়ার পূর্বেও আপনার নিয়ত বা উদ্দেশ্য থাকা জরুরি। তবে মুখে তা প্রকাশ করতে হবে বিষয়টা এমন নয়, আপনি যখন সালাতুত তাসবিহ নামাজের উদ্দেশ্যে পাক-পবিত্র হবেন বা ওজু করবেন, তখনই এটা নামাজের নিয়ত বলে গণ্য হবে।

আরও পড়ুনঃ নামাজের ওয়াজিব কয়টি ও কি কি?

মহান আল্লাহ মূলত বান্দার মনের উদ্দেশ্যটাই দেখেন। তবুও আমরা নামাজের পূর্বে আরবি বা বাংলাতে নামাজের নিয়ত করি। নিচে উক্ত নামাজের নিয়ত বাংলায় দেওয়া হলো। –

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ত

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ত আরবিতে পড়া বাধ্যতামূলত নয়। অনলাইনে অনেকেই নিয়ত বলতে যেতে সালাতুত তাসবিহ নামাজকে সুন্নত বলে অভিহিত করছে, এটি মিথ্যাচার এবং এটা একটি জঘন্য অপরাধ!

আপনি সালাতুত তাসবিহ নামাজের আগে বাংলায় এভাবে নিয়ত করতে পারেন “কেবলামূখী হয়ে আমি চার রাকাত সালাতুত তাসবীহের মুস্তাহাব নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবার।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম

সালাতুত তাসবিহ নামাজের শুরুটা অন্যান্য নামাজের মতই। অর্থাৎ, তাকবিরে তাহরিমা (আল্লাহু আকবার) বলে নামাজ শুরু করতে হবে।

তারপর ছানা পড়তে হবে। ছানা পড়ার পর ( سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ) সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার“ এই তাসবিহটি ১৫ বার পাঠ করুন।

আরও পড়ুনঃ তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, ফজিলত ও সময়

অতঃপর “আউযুবিল্লাহ” এবং ”বিসমিল্লাহ” সহ সূরা ফাতেহা পাঠ করে অন্য যে কোনো একটি সূরা মিলাতে হবে। সূরা মিলানো শেষ হলে রুকুর আগে আবারো ( سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ) সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার“ এই তাসবিহটি ১০ বার পড়ুন।

তারপর রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবিহ অর্থাৎ, (سُبْحَانَ رَبِّىَ الْعَظِيْم) সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম” ৩/৫/৭ বার পাঠ করার পর আবারো ( سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ) সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার“ এই তাসবিহটি ১০ বার পাঠ করুন।

এরপর রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় এই তাসবিহটি ( سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ) সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার“ আবারো ১০ বার পাঠ করুন।

তারপর সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবিহ (سُبْحَانَ رَبِّىَ الْأَعْلَى) সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা ৩/৫/৭ বার পাঠ করে পুণরায় ( سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ) সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার“ এই তাসবিহটি ১০ বার পড়ুন।

তারপর প্রথম সিজদা থেকে উঠে বসা অবস্থায় আবারো ( سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ) সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার“ এই তাসবিহটি ১০ বার পাঠ করতে হবে।

অতঃপর দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে প্রথমে সিজদার তাসবিহ (سُبْحَانَ رَبِّىَ الْعَظِيْم) সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম” ৩/৫/৭ বার পাঠ করে আবারো ( سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ) সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার“ এই তাসবিহটি ১০ বার পাঠ করুন।

এরপর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতেহার পূর্বে ১৫ বার, রুকুতে ১০ বার, রুকু হতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ১০ বার, প্রথম সেজদায় ১০ বার এবং সেজদা হতে উঠে বসে ১০ বার এবং দ্বিতীয় সেজদায় আবারো ১০ বার سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ পাঠ করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ নামাজে একই সূরা দুই রাকাতে পড়ার মাসআলা

২ রাকাত শেষ হলে বৈঠকে তাশাহুদ পড়ে নামাজের সাধারণ নিয়মেই তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যান। অতঃপর প্রথম রাকাতের নিয়মেই বাকি তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাত শেষ করুন। এটাই মূলত সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম।

সালাতুত তাসবিহ নামাযে করণীয়

সালাতুত তাসবিহ নামাজে যেহেতু তাসবিহ পাঠের একটি বিশেষ সংখ্যার প্রতি খেয়াল রেখে নামাজটি পড়তে হয়, সেহেতু কোনো ভাবেই যেনো তাসবীহের গণনা সংখ্যা এবং নামাজের মনোযোগে কমতি না থাকে। অর্থাৎ, তারবিহ গণনা করতে গিয়ে যেনো নামাজের একাগ্রতা নষ্ট নাহয়।

সালাতুত তাসবিহ নামাজ পড়ার আগে খুব ভালো করে মনে রাখুন, ৪ রাকাত নামাজে মোট ৩০০ বার ( سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَرُ ) তাসবিহটি পড়তে হবে। প্রতি রাকাতে মোট ৭৫ বার করে।

নামাজে দাড়িয়ে হাতের আঙ্গুল দিয়ে তাসবিহ গণনা করা যাবে না।

ফকীহগণ এ তাসবিহ গণনা নিয়ে বিশেষ এক আলামত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যেমন – যখন একবার পড়বে, তখন হাতের আঙ্গুল চাপ দিবে, এরপর দ্বিতীয়টাকে এইভাবে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, যখন স্পষ্ট সংখ্যা পূর্ণ হবে তখন অন্য হাতের আঙ্গুলকে একটার পর অন্যটাকে একইভাবে চাপবে। এইভাবে পূর্ণ দশটা সংখ্যা আদায় হয়ে যাবে। আর যদি পনের বার বলা হয় তাহলে এক হাতের আঙ্গুলকে ঢিলা করে চাপবে। পনের বার পূর্ণ হয়ে যাবে। আঙ্গুলগুলো দিয়ে পুরোপুরি গণনা না করা চাই। -(ফাতওয়া শামী) 

যদি কোনো ব্যক্তি শুধু নিজের ধারণা অনুযায়ী তাসবিহ পাঠের সংখ্যা মনে রাখতে পারে তবে অনেক ভালো। – (শামী)

আরও পড়ুনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

মাসআলাঃ যদি ভুল বশত কোনো স্থানের তাসবিহ ছুটে যায়, তাহলে তৎসংলগ্ন অন্য স্থানে আদায় করে নেবে। (শামী, ইলমুল ফিকহ : ২/৫০, ইবনে মাজাহ : ৯৯, তিরমিজি : ৯৫) 

সচারাচর প্রশ্নঃ

প্রশ্নঃ সালাতুত তাসবিহ নামাজ জামাতে পড়া যাবে কি?

উত্তরঃ হ্যাঁ, পড়া যাবে। তবে একাকী পড়াই উত্তম।

প্রশ্নঃ সালাতুত তাসবিহ নামাজ কি বিদআত?

উত্তরঃ সালাতুত তাসবিহ নামাজকে “বিদআত” বলার কোনো যুক্তকথা নেই। কারণ, উক্ত নামাজের ব্যাপারে সিহাহ সিত্তাহ কিতাবের মতো নির্ভরযোগ্য কিতাবেও হাদিস বর্ণনা রয়েছে।

হাদীসটির মান সহীহ।

সালাতুত তাসবিহ নামাজ অনেক ফজিলতপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি সম্ভব হয়, তবে দৈনিক একবার, যদি তা সম্ভব না হয় তবে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারে একবার; যদি তাও সম্ভব না হয় হবে প্রতি মাসে একবার; যদি তাও সম্ভব না হয়, তবে বছরে একবার; যদি তাও সম্ভব না হয় তবে জীবনে অন্তত একবার আদায় করুন। -(ইবনে মাজাহ)

সামনে রমজান মাস, সালাতুত তাসবিহ নামাজ পড়ার চমৎকার একটি সময়। তারাবির নামাজের পর অথবা সাহরির আগে (তাহাজ্জুদের সময়) নামাজটি পড়তে পারলে হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভূত হবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে এই ফজিলতপূর্ণ নামাজটি জীবনে একবার হলেও পড়ার তাওফিক দিন। আমিন

Leave a Comment

error: Content is protected !!