প্রিয় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীবৃন্দ, তোমাদের বাংলা ১ম সিলেবাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি গল্প হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অপরিচিতা’। এই গল্পটি তৎকালীন সমাজের যৌতুক প্রথা, নারীর আত্মমর্যাদা এবং স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার এক অসাধারণ আখ্যান। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখার ক্ষেত্রে গল্পের মূলভাব, চরিত্র বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা অপরিহার্য।
অপরিচিতা গল্পের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর
প্রশ্ন-১: আত্মমর্যাদা ও নীরব প্রতিবাদ
উদ্দীপক:
মি. হক তার একমাত্র মেয়ে ফাহমিদার জন্য পাত্রপক্ষের কাছে যৌতুক হিসেবে একটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু পাত্রপক্ষ যখন বিয়ের আসরে শেষ মুহূর্তে আরও অতিরিক্ত টাকা দাবি করল, তখন মি. হক শান্তভাবে বললেন, ‘আমার মেয়ের সম্মান ওই ফ্ল্যাট-গাড়ির চেয়ে অনেক বেশি দামি। এই অপমান সহ্য করে আমি তাকে বিয়ে দেব না।’ ফাহমিদা তার বাবার এই সিদ্ধান্তে নীরবে সম্মতি জানালো।
ক. জ্ঞানমূলক: ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণীর বাবার নাম কী?
খ. অনুধাবনমূলক: “দয়া করে আমাকে মাপ করবেন”- উক্তিটির মধ্য দিয়ে কী প্রকাশিত হয়েছে?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের মি. হকের মনোভাব ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন চরিত্রের প্রতিচ্ছবি? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: উদ্দীপকের ফাহমিদার নীরবতা ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর চরিত্রের প্রথম পর্বের নীরব প্রতিবাদের ইঙ্গিত দেয়— বিশ্লেষণ করো।
উত্তর-১
ক. ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণীর বাবার নাম হলো শম্ভুনাথ সেন।
খ. উক্তিটির (দয়া করে আমাকে মাপ করবেন) মধ্য দিয়ে শম্ভুনাথ সেনের আত্মমর্যাদাবোধ এবং অন্যায় ও লোভের বিরুদ্ধে তার দৃঢ়, অথচ শান্ত প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যৌতুকলোভী বরপক্ষের অতিরিক্ত পাওনা চাওয়ার পর তিনি নম্র ভাষায়, কিন্তু দৃঢ়তার সাথে অসম্মানজনক সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করেন, যা তার রুচিশীল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানসিকতার পরিচয় দেয়।
গ. উদ্দীপকের মি. হকের মনোভাব ‘অপরিচিতা’ গল্পের শম্ভুনাথ সেন চরিত্রের প্রতিচ্ছবি।
উভয় চরিত্রই কন্যাদায়গ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রকার লোভ বা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। শম্ভুনাথ সেন তার জামাইবাবুর (বিনায়কের) গহনা পরীক্ষার নির্লজ্জ প্রয়াস দেখে অপমানিত হন এবং কন্যার অসম্মান মেনে না নিয়ে বিনায়ককে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি টাকার চেয়েও কন্যার আত্মমর্যাদাকে বড় করে দেখেছিলেন। একইভাবে মি. হকও অতিরিক্ত যৌতুকের দাবিতে মেয়ের সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে স্থিরচিত্তে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
মি. হক এবং শম্ভুনাথ সেন, উভয়েই তৎকালীন সমাজে প্রচলিত যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। দুজনেরই স্থিরতা, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা এবং কন্যার প্রতি পিতার গভীর শ্রদ্ধা একই মানসিকতার পরিচয় বহন করে, যা তাদেরকে সমাজের কাছে মাথা নত না করা ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরে।
ঘ. বিশ্লেষণটি যুক্তিযুক্ত। উদ্দীপকের ফাহমিদার নীরব সম্মতি যেন কল্যাণীর প্রথম পর্বের নীরবতাকেই তুলে ধরে। কল্যাণীও বিবাহের আসরে পিতার সিদ্ধান্তকে নীরবে মেনে নিয়েছিল। সে সময় কল্যাণীর নিজস্ব কোনো প্রতিবাদী ভূমিকা দেখা যায়নি, যা তার বাবার দৃঢ়তার আড়ালে চাপা পড়ে ছিল। কল্যাণীর এই নীরবতা দুর্বলতা ছিল না, বরং ছিল আত্মমর্যাদার প্রথম প্রকাশ এবং পরবর্তীকালে তার স্বাধীন জীবন গড়ার ভিত্তি।
তবে গল্পের শেষাংশে কল্যাণীর স্বাবলম্বী ও সেবাপরায়ণ হয়ে ওঠা প্রমাণ করে যে, তার নীরবতা ছিল আত্মগঠনের প্রস্তুতি। কল্যাণীর সেই নীরবতা আসলে তৎকালীন সমাজে নারীর আত্মমর্যাদাবোধের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নামান্তর ছিল। ফাহমিদার নীরবতাও প্রাথমিক সম্মতির রূপ, যা পরবর্তীতে কল্যাণীর মতো স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যমে মুখর ও প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারত।
কল্যাণীর এই পরিণতি সমাজে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সফল দৃষ্টান্ত। এই নীরবতা আসলে সমাজের অন্যায়কে মেনে না নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি ছিল, যা শেষ পর্যন্ত কল্যাণীকে একজন স্বাধীনচেতা মানবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে তার জীবনের সার্থকতা আসে সমাজের স্রোতের বাইরে গিয়ে।
প্রশ্ন-২: মামা ও সামাজিক ব্যাধি
উদ্দীপক:
অখিলবাবু মনে করেন, সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে অর্থের বিকল্প নেই। তাই তার একমাত্র ভাগ্নে যখন ভালো বেতনের চাকরি পেয়েও একটি অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের মেধাবী মেয়েকে বিয়ে করতে চাইল, তখন তিনি বেঁকে বসলেন। তিনি বললেন, “বিয়ে হবে আমার পছন্দমতো ধনী পরিবারে। তা না হলে সমাজে মুখ দেখাব কী করে? গরীবের ঘরের রূপ দিয়ে কি আর মান-সম্মান রক্ষা হয়?”
ক. জ্ঞানমূলক: ‘অপরিচিতা’ গল্পে কথকের পিসতুতো ভাইয়ের নাম কী?
খ. অনুধাবনমূলক: “এই আমার মামা।”— কথক কেন এই উক্তিটি করেছেন?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের অখিলবাবু ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন চরিত্রের প্রতিনিধি? কেন?
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: ‘অপরিচিতা’ গল্পে মামা চরিত্রটি কি তৎকালীন বাঙালি সমাজের একমাত্রিক চিত্র তুলে ধরে? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর-২
ক. ‘অপরিচিতা’ গল্পে কথকের পিসতুতো ভাইয়ের নাম হরিশ।
খ. কথক (অনুপম) এই উক্তিটি (এই আমার মামা) করেছেন কারণ তিনি তার মামার চরম যৌতুকলোভ, কটু ব্যবহার ও সংকীর্ণ মানসিকতার জন্য লজ্জিত এবং ক্ষুব্ধ। মামার অন্যায্য ও হীন মনোবৃত্তির কারণেই কল্যাণীর মতো পাত্রীর সাথে তার বিবাহ ভেঙে গিয়েছিল। মামার এহেন আচরণকে তিনি সমাজের প্রতিভূ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন, তাই যেন তাকে অন্যের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি।
- আরো পড়ুন: অপরিচিতা গল্পের mcq প্রশ্নের উত্তর
গ. উদ্দীপকের অখিলবাবু ‘অপরিচিতা’ গল্পের মামা চরিত্রের প্রতিনিধি।
উভয়ের মধ্যেই অর্থের প্রতি লোভ, সামাজিক প্রতিপত্তির মিথ্যা অহংকার এবং সংকীর্ণ মানসিকতা দেখা যায়। মামা যেমন অনুপমের বিয়েতে কেবল কনের বিপুল গহনা ও টাকার দিকটি বিবেচনা করেছেন এবং মেয়ের রূপের চেয়ে অলংকারের মূল্যকে বড় করে দেখেছেন, তেমনি অখিলবাবুও ভাগ্নের পছন্দকে মূল্য না দিয়ে কেবল ধনী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সমাজে নিজের মুখরক্ষার কথা ভেবেছেন। তাঁর কাছে গরীবের ঘরের মেধাবী মেয়ের কোনো মূল্য নেই, কারণ তা সমাজের চোখে সম্মান বাড়াবে না।
এই দুই চরিত্রই তৎকালীন সমাজের সেই অর্থলিপ্সু শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করে, যারা মানবিক সম্পর্ককে তুচ্ছ জ্ঞান করত। গল্পে মামা যৌতুককে ব্যবসা হিসেবে দেখেছিলেন এবং তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। মামার কাছে অনুপমের ব্যক্তিত্বের চেয়ে অর্থই ছিল প্রধান, আর অখিলবাবুর কাছেও প্রতিপত্তিই মুখ্য। এই ধরনের চরিত্ররা মানবিক সম্পর্ক ও মূল্যবোধের চেয়ে অর্থ-বিত্তকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে সমাজের ব্যাধিকেই লালন করেন।
ঘ. হ্যাঁ, ‘অপরিচিতা’ গল্পে মামা চরিত্রটি তৎকালীন বাঙালি সমাজের একমাত্রিক চিত্র তুলে ধরে। মামা সেই সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন যেখানে:
১. যৌতুক প্রথা সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম ছিল।
২. অর্থ ও প্রতিপত্তিকে মানবিক মূল্যবোধের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো।
৩. কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে দুর্বল ভাবা হতো এবং তার উপর কর্তৃত্ব খাটানো হতো।
মামা চরিত্রটি লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা ও অবিবেচকতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর সংকীর্ণ মানসিকতা ও লোভাতুর দৃষ্টি তৎকালীন একশ্রেণির বাঙালির চরিত্রকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। মামার এই আচরণ কেবল একটি পারিবারিক ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা পুরো সমাজের একটি শক্তিশালী দিককে নির্দেশ করে। অনুপমের মামা ছিলেন সেই সমাজের ধারক ও বাহক, যিনি যুগের পরিবর্তনকে মানতে নারাজ ছিলেন।তবে, শম্ভুনাথ সেনের মতো চরিত্রও ছিল, যারা প্রতিবাদের মাধ্যমে এই একমাত্রিক চিত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাই মামা চরিত্রটি সেই সময়ের ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের শক্তিশালী প্রতীক হিসেবেই ফুটে উঠেছে। মোটকথা, মামা তৎকালীন সমাজে গেঁড়ে বসা যৌতুক প্রথা ও অর্থলোভের নির্লজ্জ প্রতিভূ ছিলেন, যা গল্পের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন-৩: রূপ ও গুণের বিচার
উদ্দীপক:
রফিক তার বন্ধুকে বলল, “বিয়ের ক্ষেত্রে কেবল বাইরের চাকচিক্য দেখা উচিত নয়। আমার মামাতো ভাই তো অনেক গহনা পরা এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু সে ছিল এক্কেবারে নিরক্ষর ও ব্যক্তিত্বহীন। অন্যদিকে, আমার আরেক বন্ধু কম সাজসজ্জার, সাধারণ এক আত্মপ্রত্যয়ী ও শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করে এখন সুখে আছে।”
ক. জ্ঞানমূলক: বিনোদবিহারীর সাথে অনুপমের সম্বন্ধ কী ছিল?
খ. অনুধাবনমূলক: “আসলে মানুষ কি চোখে দেখে?”— কথক কেন এই প্রশ্ন করেছেন?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের রফিকের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন ভাবকে সমর্থন করে? আলোচনা করো।
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণী কি বাহ্যিক রূপের ঊর্ধ্বে উঠে অনুপমকে আত্মিক সৌন্দর্যের পাঠ দিতে পেরেছিল? যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর-৩
ক. বিনোদবিহারীর সাথে অনুপমের কোনো আত্মীয়তার সম্বন্ধ ছিল না, তিনি ছিলেন অনুপমের পিতার বন্ধু।
- আরো পড়ুন: অপরিচিতা গল্পের মূল কথা বা বিষয়বস্তু
খ. কথক (অনুপম) এই প্রশ্নটি করেছেন কারণ তিনি প্রথম দেখার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কল্যাণীর রূপে মুগ্ধ হতে পারেননি বা তার আসল সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারেননি। তিনি বুঝতে পারেন, চোখ কেবল বাইরের রূপই দেখে, কিন্তু ব্যক্তিত্ব, মননশীলতা এবং আত্মিক সৌন্দর্য দেখতে পারে না। তিনি স্বীকার করেছেন, মামার হীনমন্যতার কারণে তার চোখেও গহনা ও অর্থের ছায়া পড়েছিল, তাই কল্যাণীর প্রকৃত মহিমাকে তিনি চিনতে পারেননি।
গ. উদ্দীপকের রফিকের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের মূল ভাবকে জোরালোভাবে সমর্থন করে।
রফিকের বন্ধুর সাধারণ কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী ও শিক্ষিত মেয়েটিকে বিয়ে করে সুখী হওয়া, গল্পের কল্যাণীর আত্মমহিমাকে তুলে ধরে। কল্যাণীর ছিল না কোনো অতিরিক্ত গহনা বা বাহ্যিক জাঁকজমক, যা সাধারণত সেকালের সমাজে কনের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, শিক্ষা ও আত্মনির্ভরশীলতা তাকে এক অসাধারণ মানুষে পরিণত করেছে।
গল্পে দেখানো হয়েছে, অনুপমের মামা বাহ্যিক ঐশ্বর্য দেখতে গিয়ে কল্যাণীর ভেতরের গুণাবলিকে উপেক্ষা করেছিলেন, যা তাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল এবং অনুপমকে আজীবন আফসোস করতে হয়েছে। কল্যাণীর কাছে গহনা মূল্যহীন ছিল, তার প্রকৃত সম্পদ ছিল তার আত্মমর্যাদা এবং দেশের প্রতি তার অঙ্গীকার। গল্পে প্রমাণিত হয়েছে যে, ক্ষণস্থায়ী গহনা বা ঐশ্বর্যের চেয়ে আত্মশক্তিই নারীর প্রকৃত সম্পদ ও সৌন্দর্য।
ঘ. হ্যাঁ, ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণী বাহ্যিক রূপের ঊর্ধ্বে উঠে অনুপমকে আত্মিক সৌন্দর্যের পাঠ দিতে পেরেছিল।
অনুপম কল্যাণীকে প্রথমবার দেখেছিল ট্রেনে। তখন তার সাজসজ্জা কম থাকলেও, তার ব্যক্তিত্বের তেজ ও সেবাধর্মী রূপ দেখে অনুপম মুগ্ধ হয়। কল্যাণীর এই ‘অপরিচিতা’ রূপটিই তাকে আকর্ষণ করে। ট্রেনের অপরিচিতার যে তেজস্বী রূপ অনুপম দেখেছিল, সেটাই ছিল কল্যাণীর প্রকৃত চারিত্রিক পরিচয়, যা সব ধরনের বাহ্যিক চাকচিক্যের ঊর্ধ্বে।
কল্যাণী নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, দেশের সেবাকার্যে নিজেকে নিয়োজিত করে বুঝিয়ে দেয় যে, নারীর জীবনের সার্থকতা স্বামীর ঘর বা গহনায় নয়, বরং আত্মমর্যাদা ও জনকল্যাণে। কল্যাণীর জীবনের এই স্বাধীন গতি ও মহৎ আদর্শ অনুপমের দীর্ঘদিনের মানসিক জড়তা ভেঙে দেয় এবং সে তার ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে লজ্জিত ও অযোগ্য মনে করে। কল্যাণীর এই মহৎ জীবনবোধের কাছে অনুপমের এতদিনকার সমস্ত ভুল ধারণা চূর্ণ হয়ে যায় এবং সে নিজেকে লজ্জিত ও অযোগ্য মনে করে। অনুপম উপলব্ধি করে, গহনার ভারে চাপা পড়া রূপ নয়, বরং কল্যাণীর আত্মিক ঔজ্জ্বল্যই ছিল তার প্রকৃত সম্পদ।
প্রশ্ন-৪: জীবনের সার্থকতা
উদ্দীপক:
“নদী যখন আপন বেগে চলে, তখন সে কারও পানে তাকায় না। তার লক্ষ্য শুধু সমুদ্র। মাঝপথে তার স্রোত নানা শাখা-প্রশাখার জন্ম দিলেও, মূল গতিপথ সবসময়ই থাকে স্থির ও অবিচল। অন্যদিকে, পুকুরের জল স্থির ও সীমিত। বাইরে থেকে কেউ তাকে গতি না দিলে সে কেবলই এক জায়গায় আবদ্ধ থেকে তার জলকে ঘোলা করে তোলে।”
ক. জ্ঞানমূলক: কল্যাণীর বয়স কত ছিল?
খ. অনুধাবনমূলক: “মাথার উপরে শম্ভুনাথ সেন মশায় বসিয়া আছেন”- উক্তিটিতে শম্ভুনাথ সেনের কোন গুণটি প্রকাশিত?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের নদীর গতির সঙ্গে ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন চরিত্রের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়? বুঝিয়ে দাও।
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: উদ্দীপকের পুকুরের স্থবিরতা গল্পের অনুপম চরিত্রটির প্রথম জীবনের সঙ্গে কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ— বিশ্লেষণ করো।
উত্তর-৪
ক. কল্যাণীর বয়স ছিল পনেরো বছর।
- আরো পড়ুন: মাসি পিসি গল্পের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর
খ. উক্তিটিতে শম্ভুনাথ সেনের ধৈর্যশীলতা, আত্মমর্যাদার স্থিরতা এবং পরিস্থিতির উপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের গুণটি প্রকাশিত। তার মাথা উঁচু করে বসে থাকা বরপক্ষের প্রতি তার মানসিক কর্তৃত্ব এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়, যেখানে বিনায়কের প্রতিনিধিরা ছিল লোভী ও অধীর।
গ. উদ্দীপকের নদীর গতির সঙ্গে ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণী চরিত্রের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়।
নদী যেমন আপন বেগে অবিচল লক্ষ্যে চলে, কল্যাণীও তেমনই তার জীবনের সঠিক লক্ষ্য স্থির করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর সে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে দেশসেবা ও শিক্ষার ব্রতে নিয়োজিত করে। কল্যাণী তৎকালীন সমাজের প্রথাগত ধারণা এবং নারীর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
তার জীবনের গতি বহমান নদীর মতোই, যা কারও উপর নির্ভরশীল নয় এবং সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত। এই স্বাবলম্বী জীবনধারা তার আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, যা তাকে সমাজের বহু নারীর জন্য এক অনুপ্রেরণামূলক আদর্শে পরিণত করে। কল্যাণী প্রমাণ করেছে, জীবনের লক্ষ্য স্থির থাকলে বাইরের কোনো বাধা বা অপমানের স্রোত তাকে আটকাতে পারে না। এই চলার পথেই সে অনুপমের কাছে হয়ে ওঠে এক মহৎ ‘অপরিচিতা’, যা তার জীবনের চরম সার্থকতা।
ঘ. উদ্দীপকের পুকুরের স্থবিরতা গল্পের অনুপম চরিত্রটির প্রথম জীবনের সঙ্গে অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ।
পুকুরের জল যেমন স্থির, আবদ্ধ ও অন্যের উপর নির্ভরশীল, অনুপমও তেমনই নিজের মামার অভিভাবকত্বের জালে আবদ্ধ ছিল এবং তার কোনো নিজস্ব মতামত বা ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা ছিল না। মামা যা বলেছেন, তাই সে মেনে নিয়েছে। তার নিজের কোনো ইচ্ছে বা স্বাধীন চিন্তা ছিল না, যার ফলে সে মামার হাতের পুতুল হয়ে ছিল। পুকুরের জল যেমন এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে ঘোলা হয়ে যায়, তেমনি মামার শাসনে আবদ্ধ থেকে অনুপমের ব্যক্তিত্বও ম্লান ও গতিহীন হয়ে পড়েছিল।
মামার অলস নির্ভরতার প্রভাব তার ওপর এতটাই ছিল যে, সে জীবনে কোনো ঝুঁকি নিতে বা নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেনি। তার জীবন ছিল গড্ডলিকা প্রবাহের মতো, যেখানে তার নিজের কোনো গতি বা লক্ষ্য ছিল না। এই স্থবিরতা তাকে আত্ম-উন্নয়ন বা সার্থকতার কোনো পথ দেখায়নি, বরং তাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। এর ফলেই সে জীবনের এক অমূল্য সম্পদ (কল্যাণীকে) হারাতে বসেছিল। জীবনের শুরুতে এই স্থবিরতা তাকে কোনো সার্থকতা এনে দিতে পারেনি। কল্যাণীর জীবনের সার্থকতা দেখার পরই সে নিজের জীবনের এই স্থবিরতা উপলব্ধি করে।
প্রশ্ন-৫: গহনা ও আসল সম্পদ
উদ্দীপক:
রাবেয়া তার বিবাহের জন্য তৈরি করা সোনার গহনাগুলো দরিদ্র পরিবারের অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসার জন্য দান করে দিল। তার বাবা এই সিদ্ধান্তে প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে খুশি হয়ে বললেন, “আসলে সোনার চেয়েও বড় সম্পদ হলো মানবতা, আর গহনার চেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো তোমার এই সেবামূলক মন।” রাবেয়ার স্বামীও তাকে সমর্থন করে বললেন, “এই ত্যাগই তোমার আসল অলংকার।”
ক. জ্ঞানমূলক: অনুপমের বন্ধু হরিশ কোথায় কাজ করত?
খ. অনুধাবনমূলক: বিবাহের দিন অনুপমের মন ‘অন্ধকারের মধ্যে পথ দেখিয়াছে’ বলার কারণ ব্যাখ্যা করো।
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের রাবেয়ার বাবার উক্তিটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণী কি উদ্দীপকের রাবেয়ার মতো ত্যাগ ও মানবতা দিয়ে নিজেকে অলংকৃত করতে পেরেছিল? তোমার মতামত বিশ্লেষণ করো।
উত্তর-৫
ক. অনুপমের বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করত।
খ. বিবাহের দিন অনুপমের মন ‘অন্ধকারের মধ্যে পথ দেখিয়াছে’ বলার কারণ হলো, মামার গহনা পরীক্ষার নির্লজ্জতা ও অপমানজনক আচরণের ফলে অনুপমের মনে প্রথম বারের মতো দ্বিধা ও অনুশোচনা জন্ম নেয়। এই ঘটনা তার মনের অন্ধকার দিকটিকে আলোকিত করে তোলে এবং সে বুঝতে পারে যে, তারা যে কাজটি করছে তা অত্যন্ত হীন। এই উপলব্ধি ছিল তার জীবনে প্রথমবার মামার প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজস্ব বিবেকের জাগরণ।
গ. উদ্দীপকের রাবেয়ার বাবার উক্তিটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের সেই চিরন্তন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে যে, নারীর আসল অলংকার কোনো জড়বস্তু বা গহনা নয়, বরং তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, মানবতাবোধ ও আত্মশক্তি।
গল্পের মামা যেখানে কল্যাণীর গহনা দিয়ে তার কনের মূল্য বিচার করতে চেয়েছিলেন, সেখানে কল্যাণী সমস্ত সংকীর্ণতা ও লোভের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তোলে এবং দেশ সেবার ব্রত গ্রহণ করে। কল্যাণীর চারিত্রিক গুণাবলি, তেজস্বিতা এবং সেবাধর্মী মনোভাবই প্রমাণ করে যে বাহ্যিক জৌলুস তার কাছে তুচ্ছ।
কল্যাণী তার ব্যক্তিত্ব ও সেবার মাধ্যমে এমন এক মহৎ জীবন প্রতিষ্ঠা করে, যার কাছে অনুপমের সমস্ত ঐশ্বর্য ম্লান হয়ে গিয়েছিল। রাবেয়া গহনা ত্যাগ করে যেমন মানবতাকে বড় সম্পদ মনে করেছে, কল্যাণীও তেমনি গহনা-বিহীন আত্মমর্যাদাকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ অলংকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই উক্তিটি মূলত রবীন্দ্রনাথের সেই ভাবনারই প্রতিধ্বনি— ‘নারীর জীবনের প্রধান পরিচয় তার নিজের আত্মমর্যাদার মধ্যেই নিহিত’।
ঘ. হ্যাঁ, ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণী উদ্দীপকের রাবেয়ার মতোই ত্যাগ ও মানবতা দিয়ে নিজেকে অলংকৃত করতে পেরেছিল।
কল্যাণী কেবল নিজের অপমানকেই ভুলে যায়নি, বরং সেই অপমানকে শক্তি করে সে নিজের জীবনকে জনকল্যাণে উৎসর্গ করেছিল। বিয়ের মতো প্রথাগত জীবনের আশা ছেড়ে সে নারী শিক্ষা ও সমাজের সেবামূলক কাজে নিজেকে উৎসর্গ করে।
কল্যাণীর এই জীবনের ব্রত ছিল সমাজের প্রতি এক গভীর অঙ্গীকার, যা তার আত্মাকে বিশুদ্ধ করে তুলেছিল। সে সেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে, যেমন রাবেয়া দরিদ্র শিশুদের জন্য গহনা ত্যাগ করেছে। কল্যাণীর আসল পরিচয় কোনো বধূ বা স্ত্রী হিসেবে নয়, বরং নারী শিক্ষা ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে। নিজের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে এবং পরোপকারের মাধ্যমে সে সমাজে তার মহত্ত্বের ছাপ ফেলেছিল।
তার চরিত্রের এই সেবামূলক দিকটিই প্রমাণ করে যে, সে গহনার বাইরের জগতে এক মহৎ ও মানবতাবাদী আত্মাকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, যা তার আসল অলংকার হয়ে উঠেছিল। এভাবেই কল্যাণী তৎকালীন সমাজের নারীদের জন্য এক নতুন আদর্শ স্থাপন করেছিল।
নোট : মনে রাখবে, সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় গল্পের মূল বিষয়বস্তু (যৌতুক, আত্মমর্যাদা, স্বাবলম্বিতা) এবং চরিত্রগুলোর ভূমিকা যেন স্পষ্ট থাকে।
