বিড়াল গল্পের সারাংশ বা মূল বিষয়বস্তু

বিড়াল গল্পের সারাংশ বা বিষয়বস্তু
Written by IQRA Bari

‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি রচনা। একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই বাংলা প্রথম পত্রে রচনাটি সংযোজন করা হয়েছে। বিড়াল প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কী তা জানা শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই জরুরি। এই ব্লগ থেকে আজ আমরা বিড়াল গল্পের সারাংশ বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানবো।

বিড়াল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু

‘বিড়াল’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত রম্যব্যঙ্গ রচনা সংকলন ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর অন্তর্গত। বাংলা সাহিত্যে এক ধরনের হাস্যরসাত্মক রঙ্গব্যঙ্গমূলক রচনার ভিতর দিয়ে তিনি পরিহাসের মাধ্যমে সমকালীন সমাজ, ধর্ম, সভ্যতা এবং সাহিত্য- সংস্কৃতির নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতার তীব্র সমালোচনা করেছেন।

‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি মূলত নকশা জাতীয় ব্যঙ্গ রচনা। এতে লেখক একটি ক্ষুধার্ত বিড়াল আফিংখোর কমলাকান্তের জন্য রেখে দেওয়া দুধ চুরি করে খেয়ে ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এবং সমাজের নানা অসংগতিকে উক্ত প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, ধনীর ধনে গরিবের অধিকার, ক্ষুধার্ত অবস্থায় মানুষের আচরণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক উপস্থাপন করে লেখক সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে গল্পের মাধ্যমে তাঁর সমর্থন জানিয়েছেন।

বিড়ালকে প্রহার করার জন্য উদ্যত হয়ে কমলাকান্ত নিজেই দুর্বল ক্ষুধার্ত বিড়ালের পক্ষ অবলম্বন করে যুক্তিতর্ক দাঁড় করিয়েছেন। লেখক একথা বুঝাতে চান যে, খাবার মাত্রই ক্ষুধার্তের অধিকার আছে। তা ধনীর কি দরিদ্রের সেটা বিবেচ্য কোনো বিষয় নয়।

যদি ধনীর হয় তবে তা স্বেচ্ছায় না দিলে ক্ষুধার্ত তা যেকোনো উপায়ে সংগ্রহ করবে, প্রয়োজনে চুরি করে খাবে, তাতে বিশেষ কোনো দোষ নেই বিড়ালের এই যুক্তিকে শেষ পর্যন্ত কমলাকান্ত অস্বীকার করতে পারেনি।

বিড়াল তাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, এ সংসারে ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস সবকিছুতেই তাদের অধিকার আছে। আর এ কথার মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে যত ধন-সম্পদ আছে তাতে দরিদ্র মানুষের অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিড়াল সাধ করে চোর হয়নি। তার প্রশ্ন হলো, খেতে পেলে কে চোর হয়? বড় বড় সাধু চোর অপেক্ষা যে অধার্মিক সেই বিষয়ে বিড়াল তার যুক্তি তুলে ধরেছে।

বিড়ালের স্পষ্ট উচ্চারণ- অধর্ম চোরের নয়, চোরে যে চুরি করে সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। কমলাকান্ত নিজেই নিজের মনে বিড়ালের পক্ষে এবং নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়েছে। বিড়ালের কথাগুলো সোশিয়ালিস্টিক, সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল। এভাবে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রধান অন্তরায়গুলো আমাদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

তিনি সমাজে নিম্নশ্রেণির উপর উচ্চশ্রেণির অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও দোষ চাপানোর বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করেছেন ‘বিড়াল’ রচনায়। এই রচনায় বিড়াল নিম্নশ্রেণির দরিদ্র ভুখা মানুষের প্রতিনিধি আর কমলাকান্ত যতক্ষণ পর্যন্ত ধনীর ধনবৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দেখায় ততক্ষণ পর্যন্ত সে মনুষ্য সমাজের অন্যায়কারী ধনী চরিত্রের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

‘বিড়াল’ রচনায় লেখক ‘কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই’, ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া’ প্রভৃতি প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করে শ্রমিকরা কীভাবে ফল ভোগ থেকে বঞ্চিত হয় সেই দিকে ইঙ্গিত করেছেন। মূলত জগৎসংসারে নীতির দোহাই দিয়ে, অন্যায়-প্রতিকারের বিধান দিয়ে মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়।

এক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের অবসান করে আমাদের সবাইকেই মানবকল্যাণে আত্মনিবেদন করতে হবে। এই বিশেষ আবেদনই মূলত ‘বিড়াল’ রচনায় হাস্যরসের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

বিড়াল গল্পের নামকরণ:

রচনার মূল চরিত্র হলো ‘বিড়াল’। আর তাই রচনার মূল চরিত্রের উপর ভিত্তি করেই প্রবন্ধটির নামকরণ করা হয়েছে।  বঙ্কিমচন্দ্রের এ রচনাটি প্রতীকধর্মী নকশাজাতীয় রম্যরচনা ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর অন্তর্গত। বিড়ালের প্রতীকে লেখক এখানে নিম্নশ্রেণির গরিব মানুষের ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’ এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।

এখানে হাস্যরসের মধ্য দিয়ে চোরের চুরি করার মূল কারণ, এবং তা সমাধানের জন্য পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে কমলাকান্ত যখন ওয়াটার্লর যুদ্ধে ব্যূহ রচনায় ব্যস্ত তখন তার জন্য রাখা দুধ বিড়ালে খেয়ে ফেলে। বিড়ালের এই কাজটি সংগত কি না তা নিয়েই এই রচনার মূল কাহিনি।

নিজের জন্য রাখা দুধ বিড়াল এসে খেয়ে ফেলেছে, সেই ক্ষোভে কমলাকান্ত শাস্তি দিতে চায়। মারতে গিয়েও কমলাকান্ত পারেনি। কারণ দুধে তার যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই। কেননা দুধ মঙ্গলা গাভীর, খাওয়ার জন্যই সেখানে রাখা ছিল। যার ক্ষুধা আছে, নিশ্চয় তারই প্রয়োজন, আর সে খেলেই হলো।

তাছাড়া বিড়ালের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের অধিকার সম্পর্কে কমলাকান্ত সচেতন। কিন্তু বিড়াল যদি সেই অধিকারে দুধ খেয়ে থাকে তাহলে সমাজের দৃষ্টিতে তা চুরি। কারণ সে কাউকে জানিয়ে দুধ খায়নি। অথচ ক্ষুধার্ত বলে সে ক্ষুধা নিবারণের দিকটিই বিবেচনা করেছে; চুরি, অন্যায় অপরাধের দিক বিবেচনা করেনি।

লেখক এখানে ক্ষুধায় অনু পায় না বলে গরিবের অন্যায়ভাবে ক্ষুধা নিবারণের দিকটি বুঝাতে চেয়েছেন। বিড়াল এখানে অভাবী মানুষের প্রতীক। ধনীরা তাকে খাদ্য দিলে তো সে আর চুরি করত না। তারা যে খাদ্য নষ্ট করে বা ফেলে দেয় তা যদি তারা বিড়ালের মতো ক্ষুধার্ত অভাবীদের দিয়ে দিত তাহলে তাদের কখনই চুরি করতে হতো না। অথচ তারা তা দেয় না, উল্টো চুরি করতে বাধ্য হলে শাস্তি দেয়।

এ কারণে বিড়াল যুক্তি দেখায় যে, চোর দোষী হলে কৃপণ ধনী তারচেয়ে বেশি দোষী। সেক্ষেত্রে কৃপণ ধনীরও কার্পণ্যের দন্ড হওয়া উচিত বলে সে মনে করে। কিন্তু তারা তা না করে কীভাবে তেলা মাথা তেল ঢালে, অর্থাৎ যাদের খাদ্যে অভাব নেই তাদের জন্য ভোজের আয়োজন করে।

এখানে অসাম্য ও অমানবিক দিকটি ‘বিড়াল’ রচনায় কমলাকান্তকে দেখিয়ে দেয়। কারণ কমলাকান্ত ধনীদের প্রতীক; আফিমখোর হলেও সত্যবাদী। চোর কেন চুরি করে সেটা তারা অনুভব করতে চায় না। ধনীর জন্য আয়োজিত খাদ্যের উচ্ছিষ্টটুকু দরিদ্রদের দিলেই তারা বেঁচে যায়।

এ কারণে বিড়াল প্রস্তাব দেয়- “যে বিচারক চোরকে সাজা দিবেন, তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন। তাহাতে যদি তাঁহার চুরি করিয়া খাইতে ইচ্ছা না করে, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন।” এ যুক্তির পর কমলাকান্ত বিজ্ঞের মতো তাকে ধর্মোপদেশ দেয় এবং ছানার সমান ‘ভাগ দেওয়ার লোভ দেখায়।

কিন্তু কথায় না ভুলে সে নিজের যুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। রচনার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিড়ালের দুধ চুরির অপরাধ খণ্ডনের বিষয়ের প্রাধান্য থাকায় এর নামকরণ ‘বিড়াল’ যথার্থ হয়েছে।

নামকরণের সার্থকতা:

‘বিড়াল’ রচনার মূল চরিত্র ‘বিড়াল’। তাকে কেন্দ্র করেই রচনার মূল বিষয়টি সাজানো হয়েছে। গল্পে ‘বিড়াল’ হলো নিম্নশ্রেণির অভাবী মানুষের প্রতীক যারা ক্ষুধা নিবারণের জন্য চুরি করতে বাধ্য হয়। হাস্যরসের মধ্য দিয়ে বিড়াল আত্মপক্ষ সমর্থন করে এতে তার যুক্তি তুলে ধরেছে।

‘বিড়াল’ মারাত্মক ক্ষুধার জ্বালায় অন্য কোনো উপায় না পেয়ে চুরি করতে বাধ্য হয়। আর তাকে চোর বানিয়েছে কৃপণ ধনীরা। তারা তাকে কোনো রকম সাহায্য করে না। অথচ তেলা মাথায় তেল দেয়, দরিদ্রদের দিকে তাকায় না। কাজেই চোরের শাস্তি হলে, কৃপণ ধনীদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।

কমলাকান্ত তাকে নীতি কথা শুনিয়ে পাশ থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছে। বিড়াল তাকে উল্টো শুনিয়েছে, যে বিচারক চোরের বিচার করবেন তাকে তিন দিন উপবাস থেকে তারপর রায় দিতে হবে। এসব দিক বিবেচনায় রচনার নামকরণ ‘বিড়াল’ সার্থক হয়েছে।

সারাংশ

‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত এবং চমৎকার একটি রচনা। বিড়াল গল্পের সারাংশ বা মূল বিষয়বস্তু হলো – কৃপণ ধনীর কার্পণ্য ও দুর্বল ক্ষুধার্ত মানুষের অধিকার। ক্ষুধার্ত মানুষ যদি ক্ষুধা নিবারণের জন্য চুরি করে, আর চুরি করার অপরাধে যদি সমাজে তাকে চুরির শাস্তি পেতে হয় তবে কৃপণ ধনীকে প্রথমেই শাস্তি পাওয়া উচিত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!