বিলাসী গল্পের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর

বিলাসী গল্পের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর
Written by Sabbir Ahmed

বিলাসী গল্পের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর

প্রিয় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীবৃন্দ,

​তোমাদের বাংলা ১ম সিলেবাসের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প হলো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিলাসী’। এই গল্পটি তৎকালীন সমাজের বর্ণপ্রথা, কুসংস্কার এবং মানবিক প্রেমের এক গভীর আলেখ্য। মনে রাখবে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখার ক্ষেত্রে গল্পের মূলভাব, চরিত্র বিশ্লেষণ, বিশেষ করে মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসী চরিত্রের প্রেম ও ত্যাগ এবং সমাজের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তুলে ধরা জরুরি।

নিচে ‘বিলাসী’ গল্পের সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করা হলো।

প্রশ্ন-১: মানবিক প্রেম ও সামাজিক কুসংস্কার

উদ্দীপক:

রতন একজন নিম্নবর্গের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও গ্রামের প্রভাবশালী প্রতাপের জীবন বাঁচিয়েছিল সেবাযত্ন করে। এতে প্রতাপ রতনের কাছে কৃতজ্ঞ হয় এবং তাকে বিয়ে করে। ফলে প্রতাপের জ্ঞাতিগোষ্ঠী তাদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। তারা প্রতাপকে সমাজচ্যুত করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্রতাপ তার ভালোবাসার কাছে সমাজের শত অপমান উপেক্ষা করে রতনের সাথেই জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

ক. জ্ঞানমূলক: ‘বিলাসী’ গল্পে বর্ণিত লোকালয়ের নাম কী?
খ. অনুধাবনমূলক: “ছোট জাতের মেয়েকে ভালোবাসিয়া যে মহাপাপ করিয়াছি, গ্রামের লোক সে কথা ভুলিতে দিল না”— বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের প্রতাপের জীবনযাপন ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রের কোন দিকটি তুলে ধরে? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: উদ্দীপকের ঘটনার মূল সুর ‘বিলাসী’ গল্পে প্রতিফলিত সমাজের বর্ণবিদ্বেষ ও মানবিক প্রেমের জয়— বিশ্লেষণ করো।

উত্তর-১

ক. ‘বিলাসী’ গল্পে বর্ণিত লোকালয়ের নাম হলো কাশীপুর।

খ. উক্তিটির মাধ্যমে শরৎচন্দ্র তৎকালীন হিন্দু সমাজের তীব্র বর্ণবিদ্বেষ ও কুসংস্কারের চিত্র তুলে ধরেছেন।

মৃত্যুঞ্জয় উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও নিম্নবর্ণের বিলাসীকে বিয়ে করায় গ্রামের সমাজপতিরা এটিকে মহাপাপ মনে করে। তারা কেবল সমাজচ্যুত করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং নানাভাবে অত্যাচার ও অপমান করে মৃত্যুঞ্জয়কে তার ভুলের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল, যাতে সে অনুশোচনা করে এবং বিলাসীকে ত্যাগ করে।

গ. উদ্দীপকের প্রতাপের জীবনযাপন ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রের ত্যাগ ও মানবিক প্রেমের দিকটি তুলে ধরে।

মৃত্যুঞ্জয় সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নিম্নবর্ণের বিলাসীকে বিয়ে করেছিল। কলেরা থেকে সুস্থ হওয়ার পর যখন সমাজের চাপে সে একঘরে হয়ে যায়, তখনও সে বিলাসীকে ত্যাগ করেনি। মৃত্যুঞ্জয় তার বিলাসীকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছিল যে, তার কাছে জাতের চেয়ে মানবিক সম্পর্কই বড়। প্রতাপও সমাজের শত অপমান উপেক্ষা করে রতনের সঙ্গেই জীবন কাটাতে বদ্ধপরিকর।

উভয় চরিত্রই সংকীর্ণ সামাজিক বেড়াজালকে তুচ্ছ করে মানবিক প্রেমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের জীবনযাপন প্রমাণ করে যে, প্রকৃত ভালোবাসার কাছে সামাজিক কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই।

ঘ. বিশ্লেষণটি যথার্থ। উদ্দীপকের ঘটনার মূল সুর ‘বিলাসী’ গল্পে প্রতিফলিত সমাজের বর্ণবিদ্বেষ ও মানবিক প্রেমের জয়কেই নির্দেশ করে।

সমাজে প্রতাপ ও রতনের সম্পর্ককে যেমন পাপ হিসেবে দেখা হয়েছে, তেমনি মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসীকে সমাজ থেকে একঘরে করে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রত্যাখ্যান সমাজের গোঁড়ামি ও অমানবিকতা প্রমাণ করে। তবে, প্রতাপ ও মৃত্যুঞ্জয় উভয়েই সমাজের এই নিন্দাকে মেনে না নিয়ে তাদের প্রেমের প্রতি অবিচল থাকে, যা তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রতীক। এই অবিচলতাই সমাজে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানায়। বিলাসী এবং রতনের নিঃস্বার্থ সেবা ও ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের সমস্ত ঔদ্ধত্যকে ম্লান করে দেয়।

এই চরিত্রগুলো দেখিয়ে দেয় যে, মানবিকতার বন্ধন জাতি বা প্রথার ঊর্ধ্বে। এই দুই গল্পের পরিণতিই প্রমাণ করে, যেখানে মানবিকতা ও প্রেম সত্য, সেখানে বর্ণবিদ্বেষের স্থান থাকতে পারে না, বরং মানুষে মানুষে ভালোবাসাই শ্রেষ্ঠ বন্ধন।

প্রশ্ন-২: নিঃস্বার্থ সেবা ও আত্মত্যাগ

উদ্দীপক:

স্কুলশিক্ষক রফিক সাহেবের মারাত্মক টাইফয়েড হলে তার স্ত্রী ও সন্তানরা ভয়ে তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। সে সময় তার কাজের মেয়ে রহিমা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটানা তিন মাস সেবা করে তাকে সুস্থ করে তোলে। সুস্থ হয়ে রফিক সাহেব লোকলজ্জা ভুলে রহিমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাইলে রহিমা বিনীতভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে কেবল সেবা করার অনুমতি চায়।

ক. জ্ঞানমূলক: ‘বিলাসী’ গল্পটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?
খ. অনুধাবনমূলক: “আমরা তাহাকে সাপের কামড়ানোর ওঝা বলিয়া জানিতাম” — কেন বলা হয়েছে?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের রহিমার নিঃস্বার্থ সেবা ‘বিলাসী’ গল্পের কোন চরিত্রের সেবাপরায়ণতার প্রতিচ্ছবি? ব্যাখ্যা করো।
. উচ্চতর দক্ষতামূলক: উদ্দীপকের রহিমা এবং বিলাসী উভয়েরই আত্মত্যাগ মানবিক সম্পর্কের গভীরতাকে কোন স্তরে উন্নীত করেছে— বিশ্লেষণ করো।

উত্তর-২

ক. ‘বিলাসী’ গল্পটি তৎকালীন ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
খ. ‘বিলাসী’ গল্পে বিলাসীকে সাপের কামড়ানোর ওঝা বলা হয়েছে কারণ মৃত্যুঞ্জয়ের অসুস্থতার পর কলেরা সেরে গেলে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দিলে তারা সাপুড়ের পেশা গ্রহণ করে।

বিলাসী নিজে সাপ খেলা দেখাত না পারলেও মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে সে এই কাজ করত এবং ওঝার কাজও করত। গ্রামের মানুষের কাছে তার এই পরিচয়ই প্রধান হয়ে উঠেছিল, কারণ সমাজে তার আসল পরিচয় (নিম্নবর্ণের নারী) মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

গ. উদ্দীপকের রহিমার নিঃস্বার্থ সেবা ‘বিলাসী’ গল্পের বিলাসী চরিত্রের সেবাপরায়ণতার প্রতিচ্ছবি।

রহিমা যেমন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রফিক সাহেবকে সুস্থ করে তুলেছে, তেমনি বিলাসীও মৃত্যুঞ্জয়ের কঠিন অসুখের সময় তাকে ত্যাগ করেনি। কলেরার মতো সংক্রামক ব্যাধিতে পরিবারের সবাই যখন মৃত্যুঞ্জয়কে ত্যাগ করেছিল, তখন বিলাসীই নিজের জীবনের পরোয়া না করে তার সেবা করেছিল।

সেবার বিনিময়ে বিলাসী সামাজিক অপবাদ ও সমাজের কাছ থেকে দূরে থাকার কঠিন জীবনকে বরণ করে নিয়েছিল। রহিমা এবং বিলাসী উভয়েরই এই আত্মনিবেদিত সেবা প্রমাণ করে যে, প্রকৃত ভালোবাসায় কোনো লোভ বা স্বার্থ থাকে না। তাদের সেবা কেবল কর্তব্য ছিল না, ছিল ভালোবাসার এক মহৎ প্রকাশ।

ঘ. উদ্দীপকের রহিমা এবং বিলাসী উভয়েরই আত্মত্যাগ মানবিক সম্পর্কের গভীরতাকে এক উচ্চতর স্তরে উন্নীত করেছে— যেখানে প্রেম, স্বার্থপরতা ও কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে স্থান পায়।

রহিমা তার সেবার প্রতিদান হিসেবে স্ত্রীর মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করে প্রমাণ করে যে, তার সেবার মূলে ছিল কেবলই ভালোবাসা, কোনো প্রাপ্তির আশা নয়। এই নিঃস্বার্থতা মানবিক সম্পর্কের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, যা প্রথাগত সম্পর্কের চেয়েও মহৎ। অন্যদিকে, বিলাসী মৃত্যুঞ্জয়কে ভালোবাসা ও সেবা দিতে গিয়ে সমাজচ্যুত জীবন বেছে নেয় এবং শেষ পর্যন্ত তার জীবন রক্ষার জন্য নিজে বিষপানে আত্মাহুতি দেয়।

বিলাসীর এই চরম ত্যাগ প্রমাণ করে যে, মানবিক মূল্যবোধের কাছে জীবনও তুচ্ছ। এই আত্মত্যাগ কোনো সাধারণ সম্পর্ক নয়, বরং তা সমাজের সংকীর্ণতার মুখে প্রেমের মহিমাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের এই নিঃস্বার্থ আচরণ সম্পর্কের ভিত্তিকে আরও দৃঢ় ও পবিত্র করে তুলেছে, যা সমাজের অনেক আরোপিত বন্ধনকে ভেঙে দিয়েছে।

প্রশ্ন-৩: শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজচেতনা

উদ্দীপক:

অধ্যক্ষ হাসান স্যার তার ছাত্রদের কেবল পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যেই আবদ্ধ না রেখে তাদেরকে সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন করতে চাইলেন। তিনি ক্লাসে শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পের মতো লেখা আলোচনা করে ছাত্রদের বোঝালেন যে, ডিগ্রি বা সম্পদই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস থাকাটাও জরুরি।

ক. জ্ঞানমূলক: ‘বিলাসী’ গল্পের কথকের নাম কী?
খ. অনুধাবনমূলক: “মানুষ কি শুধু বাইরের পরিচয়টাই দেখে?”— কথক কেন এই প্রশ্ন করেছেন?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের অধ্যক্ষ হাসান স্যারের মনোভাব ‘বিলাসী’ গল্পের কথক মৃত্যুঞ্জয়ের শিক্ষাগুরুদের মানসিকতার বিপরীত কেন? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: ‘বিলাসী’ গল্পটি কি উদ্দীপকের মতো শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে পারে? যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করো।

উত্তর-৩

ক. ‘বিলাসী’ গল্পের কথকের নাম ন্যাড়া।
খ. কথক এই প্রশ্নটি করেছেন কারণ তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, সমাজ মানুষের চারিত্রিক গুণাবলি, প্রেম বা আত্মত্যাগের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর চেয়ে তার বংশ, পেশা বা আর্থিক অবস্থার মতো বাইরের পরিচয়কেই বেশি গুরুত্ব দেয়।

বিলাসী নিম্নবর্ণের হওয়ায় সমাজের কাছে তার মানবিক গুণাবলির কোনো মূল্য ছিল না। অথচ সে মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছে, তা কোনো উচ্চবর্ণের নারীও করতে পারত না। তাই সমাজের এই সংকীর্ণ মানসিকতা দেখে কথক প্রশ্নটি করেছেন।

গ. উদ্দীপকের অধ্যক্ষ হাসান স্যারের মনোভাব ‘বিলাসী’ গল্পের কথক মৃত্যুঞ্জয়ের শিক্ষাগুরুদের মানসিকতার বিপরীত।

হাসান স্যার ছাত্রদেরকে কেবল পুঁথিগত বিদ্যা না দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক চেতনার শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের শিক্ষাগুরুরা ছিলেন সমাজের সেই সংকীর্ণ মানসিকতার ধারক, যারা কেবল পুঁথিগত জ্ঞানকেই শ্রেষ্ঠ মনে করত এবং সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যেতে সাহস করত না। মৃত্যুঞ্জয় যখন বিলাসীকে নিয়ে সমাজে লাঞ্ছিত হচ্ছিল, তখন তার শিক্ষাগুরুদের কেউ তাকে সমর্থন করেনি, বরং তারা নিজেদের সামাজিক অবস্থান বাঁচাতে নীরব ছিল।

এই নীরবতা আসলে সমাজের অন্যায়কে সমর্থন করারই নামান্তর। হাসান স্যার যেখানে মানবিকতার মূল্য দিতে শেখান, সেখানে মৃত্যুঞ্জয়ের শিক্ষাগুরুরা সংকীর্ণ সমাজনীতির কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন এবং মানবিক বোধের চেয়ে চিরাচরিত প্রথাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

ঘ. হ্যাঁ, ‘বিলাসী’ গল্পটি উদ্দীপকের মতো শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে পারে।

এই গল্পটি কেবল একটি প্রেমের আখ্যান নয়, বরং এটি তৎকালীন সমাজের বর্ণবিদ্বেষ, কুসংস্কার এবং সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ। শিক্ষার্থীরা এই গল্প পড়ে বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয়ের নিঃস্বার্থ প্রেম এবং আত্মত্যাগের মহিমা উপলব্ধি করতে পারে। এটি তাদের শেখায় যে, মানুষ হিসেবে সবাই সমান এবং মানবিকতার ঊর্ধ্বে কোনো জাত-পাত থাকতে পারে না। বিলাসীর ত্যাগী ও সেবাপরায়ণ জীবন শিক্ষার্থীদের অন্তরে গভীর দাগ কাটে এবং তাদের সংবেদনশীল করে তোলে, যা কেবল পুঁথিগত শিক্ষায় সম্ভব নয়।

হাসান স্যারের মতো শিক্ষক এই গল্পকে হাতিয়ার করে ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক ন্যায়বোধ ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা তৈরি করতে পারেন। গল্পটি তাদের শেখায় যে, সত্যিকারের শিক্ষা হলো বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সত্য ও মানবিকতাকে প্রতিষ্ঠা করা। ফলে, শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষায় পাস করাই নয়, বরং একজন উন্নত মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারে।

প্রশ্ন-৪: সামাজিক গোঁড়ামি ও বিবেক

উদ্দীপক:

গ্রামের জমিদার তার ছেলের বিয়েতে গরিবদের জন্য ভোজের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু জানতে পারলেন, গরিবদের মধ্যে একজন অন্ত্যজ শ্রেণির লোক লুকিয়ে খাবার খেয়েছে। এতে জমিদার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে সেই লোকটিকে মারধর করে গ্রাম থেকে বের করে দিলেন। এই ঘটনা দেখে জমিদারের বিবেকবান নাতি নীরবে কষ্ট পেল, কারণ সে জানে ক্ষুধা এবং মানবিকতা কোনো জাত মানে না।

ক. জ্ঞানমূলক: মৃত্যুঞ্জয় কেন শহরে যেত?
খ. অনুধাবনমূলক: মৃত্যুঞ্জয়কে সকলে “অত্যন্ত নিরীহ ভালো মানুষ” বলত কেন?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের জমিদার চরিত্রের মধ্যে ‘বিলাসী’ গল্পের সমাজপতিদের কোন মানসিকতা প্রতিফলিত? বুঝিয়ে দাও।
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: উদ্দীপকের নাতি ও ‘বিলাসী’ গল্পের কথক ন্যাড়ার নীরব কষ্টের মধ্যে কি একই ধরনের সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিবেকবোধের প্রকাশ ঘটেছে— বিশ্লেষণ করো।

উত্তর-৪

ক. মৃত্যুঞ্জয় শহরে যেত মূলত তার মামার বাড়িতে পড়ার জন্য।
খ. মৃত্যুঞ্জয়কে সকলে “অত্যন্ত নিরীহ ভালো মানুষ” বলত কারণ সে ছিল অত্যন্ত সরল, শান্তশিষ্ট এবং অন্যের প্রতি সর্বদা সহানুভূতিশীল।

তার সরলতা এবং সহজ-সরল জীবনযাত্রা তাকে গ্রামের মানুষের কাছে কোনো প্রকার জটিলতা বা অহংকারমুক্ত মানুষ হিসেবে পরিচিত করেছিল। এই সহজ প্রকৃতির কারণে সে সমাজে টিকে থাকতে পারেনি, যার সুযোগ নিয়েছিল তার তথাকথিত আত্মীয়-স্বজনেরা। তার এই নিরীহ স্বভাবের কারণে গ্রামের সমাজপতিরা তাকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এবং তার দুর্বলতার সুযোগ নিত।

গ. উদ্দীপকের জমিদার চরিত্রের মধ্যে ‘বিলাসী’ গল্পের সমাজপতিদের গোঁড়ামি ও অমানবিক মানসিকতা প্রতিফলিত।

জমিদার যেমন অন্ত্যজ শ্রেণির লোকটিকে খাবার খাওয়ার ‘অপরাধে’ মারধর করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, তেমনি ‘বিলাসী’ গল্পের সমাজপতিরা মৃত্যুঞ্জয়কে সমাজচ্যুত করেছিল নিম্নবর্ণের বিলাসীকে বিয়ে করার জন্য। উভয় ক্ষেত্রেই সামাজিক সম্মান ও কুসংস্কারকে মানবিকতা, ক্ষুধা বা প্রেমের চেয়ে বড় করে দেখা হয়েছে। তারা বিশ্বাস করত, নিম্নবর্ণের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে বা একই পঙক্তিতে আহার করলে তাদের তথাকথিত ধর্ম ও জাত নষ্ট হয়ে যায়।

এই গোঁড়ামি সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের অহংকারকে তুলে ধরে, যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করত। বস্তুত, উভয় ক্ষেত্রেই ধর্ম ও জাতের দোহাই দিয়ে দুর্বল মানুষের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। এই আচরণ তাদের অমানবিক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দেয়।

ঘ. হ্যাঁ, উদ্দীপকের নাতি ও ‘বিলাসী’ গল্পের কথক ন্যাড়ার নীরব কষ্টের মধ্যে একই ধরনের সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিবেকবোধের প্রকাশ ঘটেছে।

উদ্দীপকের নাতি জমিদারের অমানবিক কাজ নীরবে দেখলেও, তার বিবেক তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। সে জানে ক্ষুধা জাত মানে না। একইভাবে, ন্যাড়া যখন মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসীকে সমাজচ্যুত ও লাঞ্ছিত হতে দেখেছিল, তখন সে নিজে কিছু না বললেও, তার মনে সমাজের এই অবিচার নিয়ে গভীর বেদনা ছিল। উভয়ের নীরবতাই সেই সময়ের অসহায় প্রগতিশীল মানুষের প্রতিচ্ছবি, যারা সমাজের প্রথাগত শক্তির বিরুদ্ধে একা প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।

ন্যাড়া ও নাতি উভয়েই সমাজের প্রভাবশালী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেনি, কিন্তু তাদের নীরব কষ্ট ও বেদনা প্রমাণ করে যে, তাদের অন্তরে মানবিকতা তখনও জীবিত ছিল। এই বেদনাপূর্ণ নীরবতা তৎকালীন সমাজের সেই অসহনীয় পরিবেশকে নির্দেশ করে, যেখানে ন্যায় ও মানবিকতা পরাভূত হয়েছিল গোঁড়ামির কাছে। এই নীরবতাই ছিল গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিবেকের এক দুর্বল হলেও সত্য প্রকাশ।

প্রশ্ন-৫: সাপুড়ের জীবন ও জীবনের গতি

উদ্দীপক:

সুমন ও তার স্ত্রী রীতা সমাজের সব বন্ধন ছিন্ন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে একটি ছোট কুঁড়েঘরে বসবাস শুরু করে। সুমনের হাতে কোনো অর্থ না থাকায় তারা জীবনধারণের জন্য বাঁশ ও বেতের কাজ শুরু করে। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তারা নিজেদের জীবনে শান্তি খুঁজে নেয় এবং সমাজের তথাকথিত সুখের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

ক. জ্ঞানমূলক: মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসী কোথায় বসবাস করত?
খ. অনুধাবনমূলক: কথক কেন মৃত্যুঞ্জয়কে ‘অকাল কুষ্মাণ্ড’ বলেছিল?
গ. প্রয়োগমূলক: উদ্দীপকের সুমন ও রীতার জীবনযাপন ‘বিলাসী’ গল্পের কোন চরিত্রের জীবনের গতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উচ্চতর দক্ষতামূলক: ‘বিলাসী’ গল্পটি কি উদ্দীপকের মতো জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে শান্তি খুঁজে নেওয়ার বার্তা দেয়? যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করো।

উত্তর-৫

ক. মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসী গ্রামের বাইরে আম বাগানে একটি ছোট কুঁড়েঘরে বসবাস করত।
খ. কথক মৃত্যুঞ্জয়কে ‘অকাল কুষ্মাণ্ড’ (অসময়ে জন্মানো অপদার্থ) বলেছিল কারণ লেখাপড়ায় ভালো হওয়া সত্ত্বেও সে অত্যন্ত অল্প বয়সে বিলাসীকে বিয়ে করে।

এর ফলে সে সামাজিক জীবনে এবং উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। কথক তাকে কিছুটা স্নেহের ছলেই এই উপাধি দিয়েছিল, কারণ তার মনে হয়েছিল মৃত্যুঞ্জয় তার মেধা ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেনি।

গ. উদ্দীপকের সুমন ও রীতার জীবনযাপন ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসী চরিত্রের জীবনের গতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

সুমন ও রীতা যেমন সমাজের সব বন্ধন ছিন্ন করে নিজেদের মতো জীবন শুরু করেছে, তেমনি বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয়ও সমাজের চোখে পতিত হওয়ার পর সাপুড়ের জীবন বেছে নিয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রেই চরিত্রগুলো সমাজের প্রচলিত কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং নতুন জীবন শুরু করেছে। তারা প্রমাণ করেছে যে, সমাজের চোখে পতিত হওয়া জীবনও ভালোবাসার জোরে সার্থক হতে পারে। যদিও মৃত্যুঞ্জয়ের সাপুড়ের জীবন ছিল কষ্টের, তবু বিলাসী পাশে থাকায় সেই জীবনেও সে শান্তি খুঁজে পেয়েছিল।

তাদের এই স্বেচ্ছায় বরণ করা জীবন ত্যাগ ও আত্মিক স্বাধীনতার প্রতীক। সুমন ও রীতার কঠোর পরিশ্রমে শান্তি খোঁজা এবং মৃত্যুঞ্জয়-বিলাসীর সাপুড়ের পেশা গ্রহণ— উভয়ই প্রমাণ করে, প্রকৃত সুখ বাইরের ঐশ্বর্যে নয়, বরং ভালোবাসার মানুষটির পাশে থাকার মধ্যেই নিহিত।

ঘ. হ্যাঁ, ‘বিলাসী’ গল্পটি উদ্দীপকের মতো জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে শান্তি খুঁজে নেওয়ার বার্তা দেয়।

গল্পে মৃত্যুঞ্জয় সমাজের সমস্ত সুখ-সুবিধা ত্যাগ করে বিলাসীকে গ্রহণ করে। তাদের সাপুড়ের জীবনে বাইরের কোনো ঐশ্বর্য ছিল না, কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল গভীর ভালোবাসা ও আত্মিক শান্তি। মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে বিলাসীই ছিল তার জীবনের সমস্ত সম্পদ, যা তাকে তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা হারানোর কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল। তাদের এই সিদ্ধান্ত সমাজের তৈরি সুখের সংজ্ঞা নয়, বরং হৃদয়ের টানে পাওয়া শান্তির বার্তাই বহন করে। বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয় সমাজের প্রথাকে উপেক্ষা করে যে জীবন বেছে নেয়, তা একটি আদর্শিক জীবন না হলেও, তা ছিল প্রথাগত জীবনের চেয়ে বেশি মানবিক ও আন্তরিক। উদ্দীপকের সুমন ও রীতাও বাঁশ-বেতের কাজে নিজেদের শান্তি খুঁজে নিয়েছে।

এই গল্পটি শিক্ষার্থীদের শেখায় যে, সামাজিক প্রত্যাশা ও সম্পদের পেছনে ছোটা জীবনের সার্থকতা নয়, বরং ভালোবাসার বন্ধন এবং সৎ উপার্জনের মাধ্যমেও জীবনে প্রকৃত শান্তি অর্জন করা যায়। বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয়ের এই জীবন ত্যাগ ও প্রেমই গল্পের মূল বার্তা, যা প্রচলিত সুখের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা:মনে রাখবে, সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় গল্পের মূল বিষয়বস্তু (বর্ণবিদ্বেষ, মানবিক প্রেম, আত্মত্যাগ) এবং চরিত্রগুলোর ভূমিকা যেন স্পষ্ট থাকে।

Leave a Comment