বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৭,০৯৯ টি ভাষা প্রচলিত আছে। প্রায় সব ভাষাতেই দু’টি রীতি বিদ্যমান। তেমনী বাংলা ভাষাতেও দুটি রীতি রয়েছে। যেমন – সাধু ও চলিত ভাষা। প্রথমটি সাহিত্যের ভাষা বা লেখায় ব্যবহৃত হয়; আর দ্বিতীয়টি মুখের কথায় ব্যবহৃত হয়। আজ আমরা সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য, বৈশিষ্ট্য উদাহরণ সহ জানবো।
বাংলা সাধু ভাষার রূপ
’সাধু’ শব্দের অর্থ শিষ্ট, মার্জিত, ভদ্ররীতিসম্মত। অর্থাৎ, বাংলা ভাষায় পূর্ণ ক্রিয়াপদ সংবলিত গুরুগম্ভীর ভাষারীতিকে মূলত সাধুভাষা বলে।ইংরেজিতে Standard Literary বলা হয়।
ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় -এর মতে, “সাধারণত গদ্য সাহিত্যে ব্যবহৃত বাংলা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে। সাধু ভাষায় সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ অনেক বেশি হয়ে থাকে।
আরও পড়ুনঃ বাংলা সমার্থক শব্দ
সাধু ভাষায় সর্বনাম ও ক্রিয়াপদসমূহ পূর্ণতর ও ভাবগম্ভীর হয়। সাহিত্য ও লেখার ক্ষেত্রেও এর এর প্রয়োগ বেশি।
সাধু ভাষার উদাহরণঃ নদীর জল ছল -ছল করিতেছে। প্রবল বেগে মলয় প্রবাহিত হইতেছে। একটি পক্ষী আকাশে উড়িতেছে। দূরে একটি শৃগাল থামিয়া থামিয়া ক্রন্দন করিতেছে।
বাংলা চলিত ভাষার রূপ
মানুষের মৌখিক ভাষাকে সাধারণত চলিত ভাষা বলা হয়। অর্থাৎ, হালকা বৈশিষ্ট্যের সংকুচিত ক্রিয়াপদ দিয়ে মুখের ভাষার সাথে সারঞ্জস্যশীল বাংলা ভাষাকে চলিত ভাষা বলে। ইংরেজিতে Standard colloqual বলা হয়।
চলিত ভাষা বর্তমান পৃথিবীতে সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।
চলিত ভাষার উদাহরণঃ নদীর জল ছল -ছল করছে। প্রবল বেগে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। একটি পাখি আকাশে উড়ছে। দূরে একটি শিয়াল থেমে থেমে কাঁদছে।
সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য
ব্যবহার ও লেখার বিচারে বাংলা ভাষা দু’ভাবে ব্যবহৃত হয়। যথা- সাধু ও চলিত রীতি। নিচে বাংলা ভাষার সাধু ও চলিতরীতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
পার্থক্যগত বিষয় | সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
০১। সংজ্ঞা | যে ভাষা ব্যাকরণের নিময়-কানুন মেনে চলে তাকে সাধু ভাষা বলে। | বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক ব্যবহৃত বা মানুষের মৌখিত ভাষাকে চলিত ভাষা বলে। |
০২। ব্যাকরণ অনুরসরণ | সাধু ভাষা ব্যাকরণের অনুসারী। | চলিত ভাষা ব্যাকরণের অনুসারী নয়। |
০৩। শব্দের প্রয়োগ | সাধা ভাষায় তৎসম শব্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে। | চলিত ভাষায় তদ্ভব, তর্ধতৎসম দেশি ও বিদেশি শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। |
০৪। স্থিরতা | সাধু ভাষা অপরিবর্তনীয়। | চলিত ভাষা পরিবর্তনশীল। |
০৫। ব্যবহার | গদ্য, সাহিত্য, চিঠিপত্র ও দলীল লিখনে সাধু ভাষা যথোপযুক্ত। | চলিত ভাষা বক্তৃতা, সংলাপ, আলোচনা ও নাট্য সংলাপের জন্য উপযুক্ত। |
০৬। পদবিন্যাস | সাধু ভাষায় পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্ধারিত। | চলিত ভাষার পদবিন্যাস সর্বদা সুনির্ধারিত নয়। |
০৭। অনুসর্গ | সাধু রীতিতে অনুসর্গ হচ্ছে- হইতে, থাকিয়া, চাইতে ইত্যাদি। | চলিত রীতিতে অনুসর্গ হচ্ছে – হতে, থেকে, চেয়ে ইত্যাদি। |
০৮। প্রকৃতি | সাধু ভাষা কৃত্রিম। | চলিত ভাষা কৃত্রিমতা বর্জিত। |
০৯। সন্ধি সমাসের ব্যবহার | সাধু ভাষায় সন্ধি ও সামাসের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। | চলিত ভাষায় সন্ধি, সমাস বর্জন করে সহজ করে লেখার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। |
১০। কর্মবাচ্যের ব্যবহার | সাধু ভাষায় কর্মবাচ্যের ব্যবহার অপ্রচলিত নয়। | চলিত ভাষায় সংস্কৃতানুসারী ‘এ’ কর্মবাচ্যের ব্যবহার একেবারেই অচল। |
১১। স্বর সঙ্গতি | সাধু ভাষায় স্বর সঙ্গতি ও অভিশ্রতির ব্যবহার পুরোপুরো ভাবে বর্জনীয়। | এ ভাষায় স্বর সঙ্গতি ও অভিশ্রুতির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। |
১২। সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের ব্যবহার | সাধু ভাষায় সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের ব্যবহার পূর্ণাঙ্গরূপে হয়ে থাকে। | চলিত ভাষায় এদের আধুনিক ও সংকুচিতরূপ ব্যবহৃত হয়। |
১৩। আঞ্চলিক প্রভাব | এ ভাষায় কোনো আঞ্চলিক প্রভাব নেই। | এটা আঞ্চলিক প্রভাবাধীন। |
১৪। ধনাত্মত শব্দ | সাধু ভাষাতে ধনাত্মক শব্দের প্রাধান্য নেই বললেই চলে। | চলিত ভাষায় ধনাত্মক শব্দের প্রভাব বেশি যেমন- কনকন, ঠনঠন, ঝনঝন ইত্যাদি। |
১৫। নব ও প্রচীন | সাধু ভাষা অনেক প্রাচীন। | চলিত ভাষা অপেক্ষাকৃত আধুনিক। |
১৬। বোধগম্যতা | সাধু ভাষা সকলের বোধগম্য নয়। | চলিত ভাষা সকলের বোধগম্য। |
১৭। সময়গত | সাধু ভাষা বলতে ও শিখতে সময় বেশি লাগে। | চলিত ভাষা লিখতে ও বলতে সময় কম লাগে। |
উপসংহারঃ
বাংলা ভাষারীতিতে সাধু ও চলিত ভাষার দুটি রূপই আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। তবুও দেখা যায়, সাধু ভাষা বর্তমানে পরিত্যক্ত না হলেও অনেকটা স্থগিত প্রায়।
আধুনিক কবি -লেখক ও সাহিত্যিকদের মধ্যে সাধু ভাষার প্রবণতা ক্ষীণ। অপরদিকে চলিত ভাষা আপন গতিতে বিশাল সাহিত্য-সাগরে মিশে চলেছে।
সাধু ও চলিত ভাষা বিশেষ নিয়মে বাংলা ভাষায় দুটি বিশেষ ধারাকে পরিপুষ্ট করেছে। তাই ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই দুটি ভাষারীতির সংমিশ্রণ সম্পূর্ণ বর্জনীয়।
তাই এদের অবকাঠামো সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানলাভ করে সচেতনাতার সাথে এ দুটি রীতিকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে ব্যবহার করা আমাদের উচিত।
প্রিয় পাঠক, আমি আশা করছি সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য উদাহরণ সহ আপনাদেকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। এই বিষয়ে যদি আপনার আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।