রিকশা ওয়ালার উত্তম চরিত্র | এক মুসলিম দিনমজুর যুবক। তার বাবা বেঁচে নেই, মা বেঁচে আছে। যুবকটির শিশুবেলায় তার বাবা পরলোক গমন করেন। তারপর মায়ের আদর যত্নে বেড়ে উঠে সেই যুবক। তার মা একজন গৃহিনী। তবে তিনি সৎচরিত্রা মহিলা। তার আর কোনো সন্তানাদি নেই। এক ছেলেকে নিয়েই তার সুখী পরিবার।
বিধবা মায়ের ভিটেবাড়িটা ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে কখনই নিজেকে গরীব বলে মনে করেন না, তার ছেলেকে মহা-মূল্যবান সম্পদ মনে করেন এবং সবসময় শোকরিয়া জ্ঞাপন করে মহান রবের নিকট। অর্থের অভাবে ছেলেকে পড়াতে পারেননি। কিন্তু মায়ের প্রচেষ্টায় যুবকটি হয়ে উঠে সৎ ও চরিত্রবান। মা বৃদ্ধ বয়সে পদার্পণ করেছে। জিবিকা অর্জনের জন্য তার ছেলে দিনমজুরের কাজ করে। তবুও ভালোই যাচ্ছে মা-ছেলের দিনকাল।
ছেলের উত্তম চরিত্র গঠনে মায়ের অবদান
ছেলের প্রতি ছিল মায়ের কিছু ওসিয়ত।
- কখনই মিথ্যা বলবানা।
- কাউকে ঠকাবে না।
- সৎপথে চলে হালাল উপার্জন করবা।
- সময় মত নামাজ আদায় করবা।
- মানুষের সাথে সুন্দর মনে কথা বলবা।
এমন আরো কিছু ওসিয়ত ছিল ছেলে প্রতি। আর এই জন্যই ছেলে আজ আদর্শবান।
যুবক ছেলেটি মা এবং তাদের সংসারের উন্নতির জন্য কিছু একটা করতে চায়। শিক্ষা না থাকার কারণে কোন চাকরি নেই। তবে নিজেকে কর্মবীর হিসেবে গড়তে চায়। মা-ছেলের প্ররিশ্রমের টাকায় একটি রিকশা ক্রয় করলো। মা বৃদ্ধ হওয়ার কারণে রান্নাবান্না ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। তাদের আয়ের উৎস কেবল ছেলের রিকশা চালানো।
বৃদ্ধা মাকে বাড়িয়ে রেখে সে নিয়মিত রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হয়। বেলাশেষে কিছু অর্থ আয় করে আবার ঘরে ফিরে আসে এবং উপার্জিত সব অর্থ মায়ের হাতে তুলে দেয়। হালাল রুজির এই সামান্য টাকার মাঝেও রয়েছে অনেক বরকত। সংসারে খরচের পরও সঞ্চয় থেকে যায় টাকায় বেশ অংশ। যুবকটি ছিল ন্যায় পরায়ণ এবং নামজি।
তার কাছে মনে হতো কর্ম ব্যস্ততার চেয়ে রবের সন্তুষ্টি অর্জন এক অনন্য কাজ। তাই রিকসা চালালে গিয়ে যখনই নামজের আজান হতো তখনই রিকসা চালানো বন্ধ করে দিয়ে নামাজে দাড়িয়ে যেতো। আবার নামাজ আদায় শেষে পুণরায় কর্মে লেগে যেতো। তার এই খোদাভীরুতা দেখে অনেক পথযাত্রী নামাজি হয়ে যায়। পথযাত্রীদের নামাজ পড়ার দৃশ্যগুলো মায়ের কাছে শেয়ার করে। মা বিষ্মিত নয়য়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শ্রবণ করে। এভাবেই কাটছে দিনকাল।
কোন একদিন এক পথযাত্রী যুবকটির রিকসায় তার ব্যাগ রেখে চলে যায়। যাত্রী চলে যাওয়ার পর যুবকটি তার রিকসায় ব্যাগটি দেখতে পেলো। তারপর সেই যুবক যাত্রীকে খোঁজে পেতে অনেক চেষ্টা করতে লাগল। সেদিন আর কোন অর্থ উপার্জনের কথা ভাবেনি। যুবকটি নিজেকেই দোষারোপ করলে লাগল! সে মনে মনে ভাবতে লাগল আমার অসচেতনতার জন্যেই যাত্রী ভাইয়ের ব্যাগটি রেখে চলে যায়।
যাত্রী ভাইয়ের ব্যাগটি খুব যত্ন সহকারে তার কাছে রেখে দিলো। যুবকটির মনে একটুও কৌতুহল জাগলো না যে ব্যাগটি খুলে দেখার। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে মায়ের কাছে সম্পূর্ণ বিষয়টি বলল। মা উত্তর দিলো যতদিন না ব্যাগটি সেই যাত্রীর কাছে পৌঁছে দিবে ততদিন পর্যন্ত কোন প্রকার উপার্জনের প্রয়োজন নেই এবং বাড়িতে ফিরে আসবে না। পরদিন যুবকটি মায়ের দোয়া নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। বের হওয়ার সময় মা যুবকের হতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলো।
যেই স্থানে যাত্রীভাই ব্যাগটি রেখে চলে যায় সেই স্থানে যুবকটি গেলো। খোঁজাখুঁজিতে চলে গেল দুইদিন। এদিকে বিধবা মায়ের বুকফাঁটা আর্তনাদ ও ছেলের প্রতি দোয়া চলমান। যুবক খুব চিন্তিত। কখন দেখা পাবে সেই পথযাত্রীর। দিন ফুরিয়ে সঁন্ধ্যা নেমে এলো, এভাবে গত হতে যাচ্ছে তিনদিন। তবুও সন্ধ্যান মিলেনি পথযাত্রীর।
চতুর্থদিন ভোরবেলায় যুবক ফজরের নামাজ আদায় করতে পাশের মসজিদে গেলো। নামাজ আদায় শেষে সবাই নিজ নিজ কর্ম ব্যস্ততায় চলে গেলো। তিনরাত ঘুমাতে না পেরে যুবকের শারীরিক অবস্থা একটু দুর্বল হয়ে গেছে। তাই মসজিদে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। বিশ্রাম শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে রেখে যাওয়া রিকশারটির স্থানে গেলো। গিয়ে দেখে যুবকের সেই রিকশাটি নেই!
যুবকের মাথায় যেনো এক বিশাল আকাশ ভেঙে পড়ল! যুবকটি কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর এক বেচারা যুবকের কাছে এসে বসল এবং বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। যুবক অশ্রুসজল চোখেই সকল প্রশ্নের উত্তর দিলো। বেচারা তার কষ্টের কথা বুঝতে পেরে যুবককে এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়ালো। তারপর যুবকের সাথে সেই বেচারাও হারানো পথযাত্রীকে খুঁজতে বের হলো। খুঁজতে খুঁজতে যোহরের সময় ঘনিয়ে এলো। হঠাৎ যুবকের চোখে সেই পথচাত্রীকে দেখতে পেলো। এবার যুবক খুব আনন্দিত!
যাত্রীর কাছে গিয়ে তার হারানো সেই ব্যাগটি ফেরত দিলো। তারপর যাত্রী রিকশা ওয়ালা যুবকের এই উত্তম চরিত্র আদর্শের নিপুণতা দেখে বুকে জরিয়ে নিলো এবং যাত্রীর বাড়িতে যুবককে নিয়ে গেলো। খুব ভালোভাবেই মেহমানদারি করলো। মেহমানদারি শেষে যুবককে প্রশ্ন করা হলো ‘এই ব্যাগে কি আছে জানো’? যুবক উত্তরে বলল ’না’।
অতঃপর যাত্রীভাই নিজেই ব্যাগের ভেতরে রাখা সেই মূল্যবান বস্তুর কথা যুবকের কাছে বলল। যাত্রীভাইয়ের কথা অনুযায়ী ব্যাগে রাখা সম্পদগুলোর বর্তমান বাজারদর প্রায় ১৫ লাখেরও বেশী। যুবক বলল, ভাই আমি মুসলমান! এই ব্যাগ যেদিন পেয়েছি সেদিন থেকে এটা আমানত হিসেবে আমার কাছে গণ্য। অতএব খেয়ানত করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
যুবকের কথা শুনে যাত্রীভাইয়ের চোখে পানি এসে গেলো। তারপর যুবকের সাথে যাত্রীভাইয়ের পুরোপুরি পরিচয় হলো। যুবক তার মায়ের কথাও যাত্রী ভাইয়ের কাছে শেয়ার করলো। যাত্রীভাই যুবকের মায়ের সাথেও পরিচিত হতে কৌতুহল প্রকাশ করলো। তারপর যুবকের বাড়িতে নিয়ে গলো সেই যাত্রীকে।
যাত্রী বংশ পরিচয়ে খুব বিত্ত্বশালী ও ক্ষমতাবান। তবে তিনিও একজন আদর্শিক। তার সন্তানাদির মধ্যে একটি মেয়েই ছিল। ছেলে সন্তান নেই। গরীব, এতিমদের প্রতি তার সহানুভূতি প্রশংসনীয় বটে। যুবকটির মায়ের সাথেও কথা হলো সেই যাত্রীভাইয়ের। যাত্রী ভাইয়ের মনে যুবকের পরিবারের প্রতি এতই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জন্মালো যে, যাত্রীভাইয়ের মেয়ের সাথে সেই আদর্শবান যুবকের বিয়ের প্রস্তাব করলো!
যুবকের মা এতটাই বিষ্মিত হলো যে কথা বলতে পারছিল না। অনেকক্ষণ কথা বলার পর যাত্রীভাইয়ের প্রস্তাব গৃহিত হলো এবং অল্পদিনের মধ্যেই বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করা হলো। পরস্পরের মাঝে গভীর সম্পর্ক স্থাপন হলো। এখন থেকে সেই যাত্রী যুবকের শ্বশুর।
যুবকের জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করা হলো। যুবক এভাবেই বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হন। দুবছর পর শ্বশুরের কোম্পানির সব দায়িত্ব যুবকের কাছে হস্তান্তর করলো। যুবকের চারিত্রিক সৌন্দর্য্যের অবলীলা দেখে কোম্পনির সকল পেশাদার লোক ভালো এবং খোদাভীরুতার দিকে এগোতে থাকলো।
আর অল্পদিনের মধ্যেই কোম্পানির সফলতা তিনগুন বেড়ে গেলো! কোম্পানির সকল পেশাদারের বেতন ১০% বৃদ্ধি করা হলো। এবার সবাই নিজের বলে কাজ করে। উত্তম চরিত্র ও নিষ্ঠাবান এক যুবকের উসিলায় সবার জীবনে চলে এলো শান্তি ও আনন্দ।
রিকশা ওয়ালার উত্তম চরিত্র গল্পের শিক্ষা
একজন মায়েই পারে তার সন্তানকে আদর্শিক বানাতে। শিক্ষাই মানুষকে সৎপথ প্রদর্শন করে না। শিক্ষা হলো ভালো-মন্দ যাচাই করার পদ্ধতি। আমাদের উচিত শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে সৎ সাহস দেওয়া এবং উত্তম চরিত্র গঠনে সহযোগিতা করা।
লেখক: নাজিরুল ইসলাম নকীব
অধ্যয়নরত, কিশোরগঞ্জ